অধিকারের প্রশ্ন, গণতন্ত্রেরও

রাষ্ট্র যদি না-ই বা স্বীকার করে অভুক্ত মানুষের ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকারের গুরুত্ব, সমাজকে তো করতেই হবে। যে কোনও মৌলিক অধিকারই অলঙ্ঘনীয় বলেও বটে

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

ঝাড়খণ্ডের এগারো বছর বয়সি সন্তোষী কুমারী শুধু একটু ভাত চাইতে চাইতে মরেই গিয়েছিল। দিল্লির তিন বোন সেটুকুও চাইতে পেরেছিল কি না, কে জানে। এই মেয়েগুলো, অথবা নর্দমা পরিষ্কার করতে নেমে ভেসে যান যাঁরা— তাঁদের মধ্যে কেউ কি আপত্তি করতেন, যদি রাষ্ট্র তাঁদের কাছে দাবি করত যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য, আর বিনিময়ে দিতে চাইত দু’বেলা পেট ভরার মতো চাল? তাঁরা কি বলতেন না, হাত-পায়ের, চোখের মণির ছবি, বাপ-ঠাকুর্দার নাম-ঠিকানা, রক্তে কমতে থাকা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা— সব জানিয়ে দিচ্ছি, শুধু খেতে দাও মাই-বাপ? ছেলেমেয়েগুলো যদি স্কুল অবধি পৌঁছতে পারে, পড়তে দিয়ো; শরীর নিতান্ত বেকাবু হলে হাসপাতালের মেঝের এক কোণে শোওয়ার মতো জায়গাটুকু যেন পাই? একটা আধার নম্বরের পরিবর্তে রাষ্ট্র যদি মিটিয়ে দেয় এই সমস্ত চাহিদা, আপত্তি করত কোন আহাম্মক?
সুপ্রিম কোর্টের রায়েও কেন ভর্তুকির জন্য আধার বাধ্যতামূলক থাকল, সে প্রশ্ন করলে এই আপত্তির মুখে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। বলতেই পারেন, ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তার অধিকার আসলে মধ্যবিত্ত বিলাসিতা। ভারতের একশো ত্রিশ কোটির বেশির ভাগই ভাববেও না, যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে দু’বেলার অন্নসংস্থান করার মধ্যে আদৌ কোনও বিনিময় আছে— আর, সেই বিনিময়ে আপত্তি করার বিন্দুমাত্র কারণ আছে।
তবে কিনা, দু’একটা কথা না বললেই নয়। যে ভাবেই দেখি না কেন, ভর্তুকির জন্য আধার বাধ্যতামূলক করার একটাই অর্থ হয়— নাগরিককে তার প্রাপ্য সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকার একটা মূল্য দাবি করছে। যে তথ্যের মুদ্রায় সেই দাম মিটিয়ে দেওয়ার দাবি, বেশির ভাগ নাগরিকের কাছে তা মূল্যহীন কি না, সেটা তো আদৌ প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, নাগরিককে তার অধিকার মিটিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে রাষ্ট্র কি কোনও মূল্য দাবি করতে পারে? ইউপিএ-র আমলে ভারত এক মস্ত ধাপ এগিয়েছিল— রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক যে দাক্ষিণ্য ভিক্ষা করে না, বরং তার অধিকার দাবি করে, আইনত এই কথাটা স্বীকার করে নিয়েছিল সরকার। ভর্তুকির পরিবর্তে আধারের তথ্য দাবি করার মধ্যে আসলে ঠিক ততটাই পথ পিছিয়ে যাওয়া আছে।
ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকারকে তো সুপ্রিম কোর্টই মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। আদালতই জানিয়েছে, ব্যক্তির বিকাশের জন্য তার এমন একটা পরিসর দরকার, যেখানে সে কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, তার সিদ্ধান্তের কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়। সেটাই তার ব্যক্তিপরিসর। যে রাষ্ট্র উন্নয়ন চায়, সে কি এই পরিসরটাকে কেড়ে নিতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও বকেয়াই থেকে গেল।
ফের আপত্তি উঠবে, বেশির ভাগ মানুষের কাছে যে গোপনীয়তার অধিকার অর্থহীন— বস্তুত, দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে, অথবা সেটুকুও না খেয়ে থাকার যন্ত্রণাটুকু ছাড়া গোপন করার মতো কিছুই যাঁদের নেই— তাঁদের এই অধিকার থাকল না গেল, তাতে কী বা এসে যায়? একটু আগে বলেছিলাম, অধিকারটা যদি মূল্যহীনও হয়, তবু তা কেড়ে নেওয়ার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। এ বার বলি, অধিকারটা যে মূল্যহীন নয়, আধপেটা খেয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছেও নয়, এই কথাটা স্বীকার করার দায়িত্বও রাষ্ট্রেরই।
যে অধিকারের মূল্য মানুষই বোঝেন না, রাষ্ট্র কী ভাবে তাকে স্বীকার করে নিতে পারে, তাকে অলঙ্ঘনীয় বলে মেনে নিতে পারে? একটা আশ্চর্য উদাহরণ আছে ভারতের ইতিহাসেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ভোটাধিকার পেয়েছিলেন দেশের কার্যত প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। না, তাঁরা দাবি করেননি সেই অধিকার— বরং, ভোটার লিস্টে নামের বদলে কয়েক কেজি চাল বাড়িতে এলে ঢের খুশি হতেন অনেকেই। প্রশাসনের বহু কর্তাই জানিয়েছিলেন, এই বিপুল দেশে এখনই সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু করা অসম্ভব। কার্যত একটি মানুষের জেদ ছিল পরাধীন দেশের সব প্রজাকে স্বাধীন দেশের নাগরিক করে তোলার, তাঁদের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় শামিল করার। সেই মানুষটি জানতেন, রাষ্ট্রকে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব, তিনি এই প্রশ্নতেও জওহরলাল নেহরুর ঠিক উল্টো মেরুতে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছেন।
রাষ্ট্র যদি না-ই বা স্বীকার করে অভুক্ত মানুষের ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকারের গুরুত্ব, সমাজকে তো করতেই হবে। যে কোনও মৌলিক অধিকারই অলঙ্ঘনীয় বলেও বটে, আর গোপনীয়তার অধিকারকে লঙ্ঘন করতে দিলে তার ফল সমাজের জন্য মারাত্মক বলেও বটে। রাষ্ট্রের কাছে হাত পাতা ছাড়া যাঁদের উপায়ান্তর নেই, তাঁরাও যে প্রজা নন, নাগরিক; গণতান্ত্রিক পরিসরে রাজনীতিতে তাঁদের যে সমান অধিকার আছে, সেটা ভুললে চলবে কেন? রাষ্ট্রীয় নজরদারি তাঁদের পোষ মানিয়ে রাখতে চাইবেই। ভয় ধরিয়ে দেবে মনে যে কোনও দাবি তুললেই রাষ্ট্র ধরে নিয়ে যেতে পারে, বা নিদেনপক্ষে বন্ধ করে দিতে পারে ভর্তুকির দাক্ষিণ্যটুকু। সত্যিই পারে কি না, সেই প্রশ্নটা তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয়। এই ভয়টুকু তৈরি করে দিতে পারলেই যথেষ্ট। নিজেদের দাবি পেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াবেন তাঁরা। অথবা/এবং, আরও বেশি করে ঢুকে পড়তে চাইবেন কোনও এক নেতার বা দলের ক্লায়েন্টেলিজ়মের সামন্ততান্ত্রিক ছত্রচ্ছায়ায়।
তাতে শেষ অবধি এই মানুষগুলোর ক্ষতি। কিন্তু, শুধু তাঁদের নয়। বেসরকারি সংস্থার হাতে আধার জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ঘুচে যাওয়ায় যাঁরা বিজয়ীর আঙুল তুলেছেন আকাশপানে, তাঁদেরও ক্ষতি। গণতন্ত্র দুর্বল হলে তাঁদের অধিকারের লড়াইগুলোই বা লড়বে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন