সহিষ্ণুতার সীমা

সহিষ্ণুতার ধারণাটিতে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা নিহিত। যে আমার অনুরূপ নহে, তাহাকে আমি সহ্য করিয়া লইলেই সহিষ্ণুতার দাবি মিটিয়া যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩২
Share:

অসহিষ্ণুতার গরল সমাজের কতটা ক্ষতি করিতে পারে তাহা দুনিয়ার বহু দেশ দেখিতেছে। বর্তমান ভারত সেই তালিকায় প্রথম সারিতে। অসহিষ্ণুতা এই দেশে নূতন নহে, কিন্তু গত কয়েক বছরে তাহার ব্যাপ্তি ও তীব্রতা অভূতপূর্ব মাত্রা অর্জন করিয়াছে। তাহার সমান্তরাল পথে অভূতপূর্ব গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়াছে অন্য একটি শব্দ: সহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা খারাপ, সহিষ্ণুতা ভাল— এই সরল ছকটি দেখিতে দেখিতে এক চরম সত্য হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, অধিকাংশ সরল ছকের মতোই, এই সিদ্ধান্তটি লইয়াও কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। সহিষ্ণুতা নিশ্চয়ই ভাল। অবশ্য কেহ তর্ক তুলিতে পারেন, অন্যায়ের প্রতি, অবিচারের প্রতি, অসাম্যের প্রতি সহিষ্ণুতা তো ভাল নহে! কিন্তু যে প্রসঙ্গে অসহিষ্ণুতা লইয়া সমকালীন সঙ্কট, সেই প্রসঙ্গে সহিষ্ণুতাকে মন্দ বলিবার প্রশ্ন উঠে না— ভিন্ন মতের প্রতি, ভিন্ন ধর্ম বা জাতি বা জীবনাচরণের প্রতি সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে সমাজের মঙ্গল করে, সমাজকে শক্তিও দেয়। তবুও প্রশ্ন— সহিষ্ণুতাই কি যথেষ্ট? ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জাতি, এক কথায় ভিন্নতা বা অপরত্বের প্রতি সহিষ্ণু থাকিলেই কি একটি উদার গণতান্ত্রিক সমাজের নিশ্চিন্ত বোধ করিবার কারণ আছে? না কি, যথার্থ গণতান্ত্রিক উদারতা সহিষ্ণুতা অপেক্ষা অধিক কিছু দাবি করে?

Advertisement

এই প্রশ্ন বাঙালির শারদোৎসব উপলক্ষে আরও এক বার উঠিয়াছে। উঠিয়াছে কলিকাতার এক সমাজকর্মীর একটি মন্তব্যের সূত্রে। দুর্গাপূজায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যোগ দেন। প্রত্যাশিত ভাবেই তাহাকে সহিষ্ণুতার প্রকাশ বলিয়া অভিহিত করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ওই সমাজকর্মীর মন্তব্য: এই মেলামেশাকে নিছক সহিষ্ণুতা বলা ঠিক নহে। তিনি পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালবাসাকেও চিহ্নিত করিতে চাহিয়াছেন, তাহাকে স্বীকৃতি দিবার কথা বলিয়াছেন। কথাটি মূল্যবান। সহিষ্ণুতার ধারণাটিতে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা নিহিত। যে আমার অনুরূপ নহে, তাহাকে আমি সহ্য করিয়া লইলেই সহিষ্ণুতার দাবি মিটিয়া যায়। কিন্তু সতেজ, সবল সমাজজীবনের দাবি তাহাতে মিটে কি? যে সামাজিকতা মানুষকে তাহার বিচ্ছিন্ন সত্তা হইতে সামগ্রিক মনুষ্যত্বে উত্তরণের পথ বলিয়া দিতে পারে, তাহা কি অপরকে মানিয়া লইবার নীরক্ত ঔদাসীন্যে চরিতার্থ হইতে পারে? এখানেই সমাজকর্মীর মন্তব্যের তাৎপর্য। পারস্পরিক সম্মান এবং ভালবাসার যে প্রয়োজনকে তিনি চিহ্নিত করিয়াছেন, তাহা এই কারণেই মূল্যবান। সামাজিক সংহতি বা সমন্বয়ের অর্থ কেবল সহাবস্থান নহে, সহযোগ। সপ্রাণ, সক্রিয় সহযোগ। সামাজিকতা সেই সহযোগ দাবি করে।

এই সূত্রে আরও একটি প্রশ্ন। পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালবাসার পাশাপাশি বিভিন্ন মত ও পথের টানাপড়েনও চলিবে না কেন? যাহাকে অপর বলিয়া ভাবিতেছি, তাহাকে সম্মানজনক দূরত্বে সরাইয়া রাখিবার পরিবর্তে তাহার সহিত যথার্থ তর্কের প্রয়োজন অনেক বেশি। তর্কের ভিত্তিতে থাকিবে পারস্পরিক ভিন্নতা, স্বাতন্ত্র্য, এমনকি বিরোধ, যে বিরোধ জীবনাদর্শের মৌলিক চরিত্রের বিরোধও হইতে পারে। কিন্তু সেই বিরোধিতা যত মৌলিকই হউক, তাহাকে শত্রুতা বলিয়া ভুল করিবার কারণ নাই। বরং বিরোধিতাকে এড়াইয়া গিয়া লোকদেখানো সহিষ্ণুতার আশ্রয় লইলেই তাহা শত্রুতার সূতিকাগারে পরিণত হইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ হয়তো তাহার এক তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন। এই সমাজে ধর্ম বা জাতপাতের ভিত্তিতে বৈরিতার প্রকাশ অন্য অনেক রাজ্য অপেক্ষা সীমিত ও স্তিমিত। বঙ্গসমাজকে, অন্তত স্বাধীনতাপরবর্তী কালে (তুলনায়) অ-সাম্প্রদায়িক মনে করিবার যে ধারাটি প্রচলিত, তাহাকে অযৌক্তিক বলা চলে না। তাহার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ইতিহাসই পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রকোপ কিছুটা প্রশমিত রাখিয়াছে। কিন্তু একই সঙ্গে ইহাও অস্বীকার করা চলে না যে, যথার্থ অসাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই এই সমাজে কার্যকর থাকে এক ধরনের অ-সহযোগী সহাবস্থান। বিভিন্ন বর্গের মানুষ পরস্পরকে দূরে রাখিয়া সহাবস্থান করে। সম্মান বা ভালবাসা দূর স্থান, সেই শীতল দূরত্ব তর্ক বা কলহের সুযোগও রাখে না। সমাজের নিম্নকোটির প্রতি উচ্চকোটির নাগরিকের কঠিন উপেক্ষা দূরত্ব কমাইবার সম্ভাবনাকেও প্রতিহত করে। পরস্পরকে ভালবাসিতে না পারিলেও, অন্তত খোলা মনে ঝগড়া করিলেও দূরত্ব কিছুটা কমে। তাহার মূল্যও কম নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন