চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পাঠ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের নাটকে তাই হত, রূপকথার গল্পের মতোই রাজা-রানিকে নিয়ে নাটক লিখতেন। মন দিয়ে সে নাটক পড়লে অবশ্য বোঝা যেত গভীর কথাই বলতে চাইছেন তিনি। 

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৮ ০১:১৬
Share:

শেষযাত্রায়। ফাইল চিত্র

ছোটবেলার সেই সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের গল্প তো সকলেরই চেনা। এক সঙ্গে অনেক সোনার ডিমের আশায় পেট কাটায় হাঁস গেল মরে, ডিমও আর পাওয়া গেল না। অতি লোভে তাঁতি নষ্টের উদাহরণ এই গল্পটি। চেনা রূপকথার গল্প অনেক সময় রূপান্তরে ধরা দেয়, আরও ‘বড়’ কথা বলে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে তাই হত, রূপকথার গল্পের মতোই রাজা-রানিকে নিয়ে নাটক লিখতেন। মন দিয়ে সে নাটক পড়লে অবশ্য বোঝা যেত গভীর কথাই বলতে চাইছেন তিনি।

Advertisement

তাঁর নাটকে মাঝে মাঝে ফিরে আসত রাজাদের কথা। তারা ঠিক কোন দেশের রাজা তা অনেক সময় জানা যেত না, জানা গেলেও সে দেশ কোথায় বোঝা যেত না। ভূগোলের মানচিত্রে তাদের নাম নেই। ফলে, সেই রাজাদের কাহিনি পড়তে গিয়ে অনেকে ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ বুঝি পুরনো দিনের কথা লিখছেন। রবীন্দ্রনাথ তা কিন্তু আদপে লিখতেন না। তাঁর এই রাজা-রাজড়াদের কাহিনিতে সমকালের সমস্যাই ধরা পড়ত, আকারে-ইঙ্গিতে। সে সঙ্কট শুধু সমকালের নয়, আসলে চিরকালের। রবীন্দ্রনাথ তাই খানিক রূপকথার আদলে লিখতেন তাঁর নাটকের কাহিনি। নানা-কালের মানুষের মৌলিক কিছু সমস্যার ধারক সেই নাটকগুলি।

রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ নাটকের রাজা বলেছিলেন, তিনি লোভ বাড়ানোর জন্য রাজত্ব করেন না, লোভ তৃপ্ত করার জন্য রাজ্য চালান। কথাটা কেন বলেছিলেন তিনি? খেয়াল করলে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় মাঝেমাঝেই লোভী মানুষের দেখা মেলে। এই লোভের পেছনে কাজ করে আকাশছোঁয়া চাহিদা। রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করছিলেন বিশ শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ও তার পরে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য মাঝেমাঝেই মানুষের চাহিদাকে আকাশ প্রমাণ করে তোলা হত। সেই চাহিদা পূর্ণ করার জন্য উৎপাদনের পালে হাওয়া লাগে। কিছু মানুষের চাহিদা তাতে খানিকটা পূর্ণ হয়, বাকিদের প্রয়োজনের সামান্য জিনিসও কিন্তু মেলে না। তৈরি হয় বৈষম্য, অসামঞ্জস্য।

Advertisement

আরও পড়ুন: অন্তিমযাত্রায় কবি, সেই ২২শে শ্রাবণের কয়েকটি মুহূর্ত

রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন ও লিখেছিলেন গ্রামকে রিক্ত করে শহর ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এক দলের লোভ অন্য দলকে শেষ করে দিচ্ছে। ভূসম্পদের এই বিত্তহরণের কাহিনি, কিছু মানুষের চাহিদার জন্য অন্যদের শেষ হয়ে যাওয়ার কাহিনি রবীন্দ্রনাথের নাটকে ফিরে ফিরে আসে। এই অর্থনীতি যেন সোনার সব ডিম এক সঙ্গে দখল করার অর্থনীতি। করতে গিয়ে হাঁসের মৃত্যু। হাঁসের মৃত্যু হয় রূপকথায়, বাস্তবে ধ্বংস হয় নিসর্গ, পরিবেশ। কিছু মানুষের সর্বগ্রাসী চাহিদার জন্য বাকিদের প্রাণ যায়। তাই শারদোৎসবের রাজা বলেছিলেন, তিনি লোভবৃদ্ধির জন্য রাজ্য চালনা করেন না, লোভতৃপ্তির জন্য রাজ্য চালনা করেন। রবীন্দ্রনাথেরও অন্যতম ভাবনা ছিল, কী ভাবে মানুষের লোভ কমানো যায়! কাজটা কঠিন।

অনেকে লোভ কমানোর জন্য সহজ একটা পন্থা নেন। ভাবেন দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাক। কোনও এক সময় যাদের আছে তাদের কাছ থেকে হরণ করে যাদের নেই তাদের সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার আদর্শের কথা ভাবতেন অনেকে। পুরনো রবিনহুড কিংবা রঘু ডাকাতের গল্পের মতো খানিকটা।

আবার এই ‘তত্ত্বের’ আরও একটা আধুনিক চেহারা হতে পারে। কোনও রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার হরণ করে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কথা বলে তা হলে কেমন হয়? রাষ্ট্র সবাইকে সমান ভাবে সুবিধে-সম্পদ দেবে। সকলেই জানেন সে চেষ্টা হয়েছিল, তবে দেখা গেল নানা সমস্যা।
মানুষের মন খুব জটিল। সবাইকে সমান করতে গিয়ে লোভ ও দুর্নীতি উস্কে উঠল অন্য পথে। সকলের সমান হওয়ার বদলে মানুষের যৌথ-খামারে কিছু মানুষ হয়ে উঠলেন ‘অধিকতর সমান’। ক্রমে তাঁরাই দখল করলেন ক্ষমতা।

রবীন্দ্রনাথ তাই চেষ্টা করলেন ছোটখাটো স্তরে গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে এমন একটা ব্যবস্থা করতে যা মানুষের চাহিদাকে দানবীয় করে তুলবে না। মানুষ বুঝদার হবে। নিজের সম্পদ ব্যক্তিগত ও সামাজিক—দু’ক্ষেত্রেই ব্যবহার করবে। জীবনে প্রাচুর্য থাকবে নায় তবে মোটের উপরে স্বাচ্ছন্দ্য ও শ্রী থাকবে। কলকাতা থেকে দূরে বর্ধমান ছোঁয়া বীরভূমে রবীন্দ্রনাথের পল্লি উন্নয়নের কাজকর্ম শুরু হল। নিজে যে ভাবে থাকতেন শান্তিনিকেতনে তা-ও দেখার মতো। সে থাকায় প্রাচুর্য ছিল না, সৌন্দর্য ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন—অন্যদেরও সে ভাবে থাকতে উদ্বুদ্ধ করতেন। শান্তিনিকেতন সংস্কৃতি বলতে এই জীবনযাপনের রকমকে বোঝায়।

শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ল রবীন্দ্রনাথের। শান্তিনিকেতনে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা নেই। তাই কলকাতায় আনতে হয়েছিল। যেতে চাননি শহরে। শান্তিনিকেতনে থাকতে চেয়েছিলেন। নানা কারণে শেষ দিনগুলিতে সেখানে থাকা হল না।

শান্তিনিকেতনে এখন আসেন অনেকে, দেখেন চারপাশ। তারপরে পর্যটকেরা চলে যান। শান্তিনিকেতন কিন্তু নিছক পর্যটন কেন্দ্র নয়। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জীবনযাপনের আদর্শ বহনকারী প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ মানুষের লোভকে বৃদ্ধি করার শিক্ষা দিতেন না, লোভতৃপ্ত করার সাধনার কথা বলতেন। নিজের মনের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া হলেই লোভ তৃপ্ত হতে পারে। এই বোঝাপড়ার ফলেই জেগে ওঠে মনের শক্তি। অন্যকে দখল না করার, নিজের চাহিদাকে সীমিত রাখার ক্ষমতাকে আত্মশক্তি বলা চলে। ব্যক্তিগত চাহিদাকে উস্কে না তুলে জীবনযাপনে শ্রীময়তার সন্ধান জরুরি। কথাটা রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবসে বারবার মনে হয়।

লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন