National news

সময়োপযোগী বার্তা রাষ্ট্রপতির

সভ্য সমাজ তথা সভ্য জাতি কাকে বলে, মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। আমার পড়শির প্রতি আমার আচরণই বলে দেয়, আমি কতখানি সুশীল।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২৩
Share:

রামনাথ কোবিন্দ। —ফাইল চিত্র।

যে শিশুটা কোনও দূর নির্জন নদীর ধারে কিংবা কোনও প্রান্তরের গাছের ছায়ায় সম্ভবত পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে অনেক দিন ধরেই খোঁজা হচ্ছে। কারণ আমাদের বিশ্বাস, ওই শিশুই উলঙ্গ হয়ে পড়া রাজাকে জিজ্ঞাসা করতে পারবে যে, রাজার কাপড়টা কোথায় গেল? শুধু রাজাকেই বা কেন, আমাদেরও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে পারে ওই শিশু, আমাদের অবয়বের সামনেও আয়নাটা ধরতে পারে সে। কিন্তু সে শিশুর খোঁজ কিছুতেই মিলছে না। অতএব রাষ্ট্রপ্রধানকেই সক্রিয় হত হল। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নাগরিকদের মুখের সামনে একটা আয়না তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। আমাদের মুখগুলো আদৌ সভ্য পৃথিবীর বাসিন্দাদের মুখের মতো লাগছে কি না, তা দেখার একটা বন্দোবস্ত করে দিলেন তিনি।

Advertisement

সভ্য সমাজ তথা সভ্য জাতি কাকে বলে, মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। আমার পড়শির প্রতি আমার আচরণই বলে দেয়, আমি কতখানি সুশীল। উৎসবে-ব্যসনে মেতে ওঠার সময় হোক, প্রতিবাদে-বিক্ষোভে সরব হওয়ার ক্ষেত্রে হোক, অধিকার প্রয়োগের প্রশ্নে হোক, সহ-নাগরিকের স্বাধীনতার কথাটা প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাথায় রাখতে হয়— মনে করিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। আমার উল্লাস বা আমার আক্রোশ বা আমার কার্যকলাপ যাতে আমার পড়শির বা অন্য কোনও নাগরিকের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে, যাতে অন্য কারও অধিকারের পরিসরকে সঙ্কুচিত না করে, সে কথা আমাকেই খেয়াল রাখতে হবে। এই বোধই সভ্যতা, এই চেতনাই সুশীল। বিস্মৃত হই আমরা সে কথা মাঝে-মধ্যেই। বিস্মৃতির লক্ষণ যখন সুস্পষ্ট পারিপার্শ্বিকতায়, ঠিক তখনই সংবিধানের অভিভাবক সক্রিয় হলেন। দেশকে মনে করিয়ে দিলেন নাগরিক অধিকার এবং নাগরিক কর্তব্যের সুনির্দিষ্ট গণ্ডিগুলোর কথা।

প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র একটি সুগঠিত, সুসংহত ব্যবস্থাপনা, যা প্রজার মতানুসারে পরিচালিত, যা প্রজার চাহিদা পূরণের কথা খেয়াল রাখে, যা প্রজার অধিকারকে সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু মাথায় রাখা দরকার, প্রজার মতানুসারে চলার অর্থ প্রজার অন্ধ ভাবাবেগে সওয়ার হওয়া নয়।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

যে কোনও প্রশ্নে সব নাগরিক একই উত্তর লিখবেন, যে কোনও বিষয়ে সব প্রজা সহমত হবেন, এমন কল্পনাও অনুচিত। প্রজাতন্ত্রে বা গণতন্ত্রে মতানৈক্য থাকে, বাদ-প্রতিবাদ থাকে, দাবি-পাল্টা দাবি থাকে। নির্যাসটা খুঁজে নিয়ে সর্বদা সঠিক দিশায় পা বাড়ানোই রাষ্ট্রের কাজ। সঠিক দিশায় পা বাড়ালেই যে পথ কুসুমাস্তীর্ণ হয়ে ওঠে, তা-ও নয়। সাধু উদ্যোগের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা হয় অনেক সময়ই। সে সব সামলে গন্তব্যে পৌঁছনোই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। অতএব নৈরাজ্যকে কোনও মূল্যেই প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।

আরও পড়ুন: সম্মান দিন ভিন্ন মতকে: কোবিন্দ

সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে নির্বাচিত হয়, এ কথা ঠিক। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরে সরকার আর সংখ্যাগরিষ্ঠের থাকে না, আপামর জনগোষ্ঠীর হয়ে ওঠে। তাই প্রত্যেক নাগরিকের প্রতিই সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্য সমান। জনসংখ্যার কোনও আগ্রাসী অংশ কথায় কথায় ফুঁসে উঠবে, প্রতাপ দেখানোর চেষ্টা করবে, হিংসার আশ্রয় নেবে আর সরকার বার বার তাদের সামনে আত্মসমর্পণের রাস্তায় হাঁটবে, এ দৃশ্য একেবারেই কাম্য নয়। কারণ এ দৃশ্য বারবার তৈরি হলে গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র পরিণত হয় ‘হল্লা-তন্ত্রে’ বা ‘ভিড়-তন্ত্রে’।

আবার বলি, নাগরিকের অন্ধ ভাবাবেগ বা অনিয়ন্ত্রিত আবেগ সরকারের নিয়ন্ত্রক বা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক হতে পারে না। নৈরাজ্য, অনাকাঙ্খিত আগ্রাসন, মাৎস্যন্যায় ইত্যাদির হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার ব্যবস্থাই হল রাষ্ট্র। দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও নৈরাজ্যের বীজ কিন্তু নির্মূল হয়নি। সে বীজ রয়ে গিয়েছে আমাদের মধ্যেই ইতস্তত। আইন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নীতি-নৈতিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, যৌথ নেতৃত্ব, স্বীকৃত প্রগতিশীল চিন্তাধারা ইত্যাদি নানান দেওয়াল তুলে রাখি আমরা নৈরাজ্যের প্রবণতাগুলোকে আড়াল করে রাখার জন্য। যে কোনও যুগে, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও সভ্যতায় রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবতারণা এই উদ্দেশ্যেই হয়েছে। সুদূর ভূমধ্যসাগরের প্রান্তে রোমান সভ্যতা হোক বা ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধু অববাহিকায় বিস্তার লাভ করা সভ্যতা, আধুনিক পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্র আমেরিকা হোক বা বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত— রাষ্ট্রের বুনিয়াদি লক্ষ্য সর্বত্রই একই। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং নাগরিক উভয়ের জন্যই এই সত্যের অনুধাবন অত্যন্ত জরুরি।

রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সময়োপযোগী বার্তাই দিলেন অতএব। নৈরাজ্যবাদ রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় পাচ্ছে বলে যখন বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হওয়ার উপক্রম হয়, তখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকেই সে ধারণায় আঘাত দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে। না হলে সভ্য রাষ্ট্রের ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সংবিধানের সর্বোচ্চ অভিভাবক ভারতীয় রাষ্ট্রকে সেই অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন