দ্বৈরথ

আরবিআই আইনের ৪৭তম ধারা বলিতেছে, অনাদায়ী এবং সন্দেহজনক ঋণের দায় মিটাইয়া, সম্পদের অবমূল্যায়নের হিসাব রাখিয়া, কর্মীদের বেতন এবং পেনশন চুকাইয়া, আপৎকালীন তহবিলের জন্য টাকা রাখিয়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের বন্দোবস্ত করিবার পর ব্যাঙ্কের লাভ হইতে যে টাকা বাঁচে, ব্যাঙ্ক তাহা সরকারের হাতে তুলিয়া দিবে। ইহাই উদ্বৃত্ত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০২
Share:

ক্ষমতার লড়াইয়ে কি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পরাস্ত হইল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক? প্রশ্নটি দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এই মুহূর্তে অতি জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক, কারণ অর্থনীতির এই দুই প্রধান পরিচালকের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেমন স্বাভাবিক, তেমনই জনসমক্ষে সহযোগিতার আবহটিও বজায় রাখা তেমন গুরুত্বপূর্ণ। দালাল স্ট্রিট ও নর্থ ব্লক উভয়েই সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। ক্ষমতার যে লড়াই অতি গোপন থাকা বিধেয় ছিল, নভেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহ জুড়িয়া জাতীয় মঞ্চে সেই কুনাট্য চলিল। সেই দ্বৈরথের ফল কী হইল, প্রশ্নটি জরুরি— কারণ, ক্ষমতার ভারসাম্যটি যদি সরকারের দিকে ঝুঁকিয়া পড়ে, তবে অর্থনীতির সিদ্ধান্তে রাজনীতির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা তীব্রতর হয়। তাহার ফল বিষম। ১৯ তারিখের বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলি আপাতদৃষ্টিতে সমঝোতার কথা বলে। কিন্তু, ভাঙিয়া দেখিলে, সে সিদ্ধান্তগুলি একান্তই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হওয়া বিধেয় ছিল, সেগুলিকে বিবিধ কমিটির দিকে ঠেলিয়া দেওয়ার অর্থ একটিই— ব্যাঙ্কের স্বায়ত্তশাসনে হাত পড়িতেছে। অনেকগুলি প্রশ্ন লইয়া আলোচনা হইয়াছে। আপাতত সর্বাপেক্ষা গুরুতর প্রশ্নটির কথা বিবেচনা করা যাউক। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত অর্থের উপর বাড়তি দাবি জানাইয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। বৈঠকে স্থির হইয়াছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত করিবার জন্য উভয় পক্ষের মনোনীত সদস্যদের লইয়া কমিটি গঠিত হইবে। অতীতের উদ্বৃত্ত অবশ্য আলোচনার বাহিরেই থাকিবে। কমিটির বিবেচ্য হইবে ভবিষ্যতের উদ্বৃত্ত। এত কাল এই সিদ্ধান্তের অধিকার ছিল ব্যাঙ্কের। অতঃপর প্রশ্ন, ব্যাঙ্ক যে সিদ্ধান্ত করিত, কমিটির সিদ্ধান্ত কি সমরূপ হইবে? না কি, সেই সিদ্ধান্তে সরকারের ইচ্ছাই প্রাধান্য পাইবে? আশঙ্কাটি স্পষ্ট যে আপাতদৃষ্টিতে যাহা উভয় পক্ষের নিকট গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র বলিয়া মনে হইতেছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা ব্যাঙ্কের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া।

Advertisement

কিন্তু, তাহারও পূর্বে প্রশ্ন, ব্যাঙ্কের হাতে উদ্বৃত্ত কাহাকে বলে? আরবিআই আইনের ৪৭তম ধারা বলিতেছে, অনাদায়ী এবং সন্দেহজনক ঋণের দায় মিটাইয়া, সম্পদের অবমূল্যায়নের হিসাব রাখিয়া, কর্মীদের বেতন এবং পেনশন চুকাইয়া, আপৎকালীন তহবিলের জন্য টাকা রাখিয়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের বন্দোবস্ত করিবার পর ব্যাঙ্কের লাভ হইতে যে টাকা বাঁচে, ব্যাঙ্ক তাহা সরকারের হাতে তুলিয়া দিবে। ইহাই উদ্বৃত্ত। ২০১৭-১৮ সালে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিটের আয়তন ছিল ৩৬.২ লক্ষ কোটি টাকা। তাহার ২৬ শতাংশ হইল ব্যাঙ্কের রিজ়ার্ভ, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক নিজের হাতে যে টাকা গচ্ছিত রাখে। আইন অনুসারে, এই টাকা দাবি করিবার কোনও অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের নাই। গোল পাকিয়াছে এইখানেই। সরকারের বক্তব্য, এত টাকা হাতে রাখিবার কোনও প্রয়োজন ব্যাঙ্কের নাই। তাহা হইতে সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করিতেছে। কিন্তু, টাকা কি সত্যই আছে? না কি, যাহা আছে, তাহা ধারণামাত্র? রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের এই রিজ়ার্ভের একটি অংশ আছে সোনায়, যাহার মূল্য বাজারদরের সহিত পাল্টায়। বাকি অংশ আছে মূলত ভারত ও অন্যান্য দেশের সরকারি সিকিয়োরিটিতে, বিদেশি মুদ্রায়। সম্প্রতি টাকার অবমূল্যায়নের ফলে টাকার অঙ্কে এই সম্পদের দাম বাড়িয়াছে। তাহাকে কি বৃদ্ধি বলে? এবং, যদি বলেও, তাহার কত অংশ ব্যাঙ্কের হাতে থাকিবে, আর কতখানি সরকারকে দেওয়া হইবে, এই সিদ্ধান্ত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য কেহ করিবে কেন? ভোটের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার বিলক্ষণ বাড়তি অর্থ দাবি করিবে। তাহাতে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণও কমাইয়া দেখানো যায়, আবার জনতোষণেও খরচ করা চলে। কিন্তু, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ করিয়া সেই টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করিতে চাহিলে তাহা দেশের অর্থনীতির পক্ষে দুঃসংবাদ। গণতন্ত্রের পক্ষেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন