অমর্ত্য সেন বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিজেদের বিভেদ ভুলিয়া ঐক্যবদ্ধ ভাবে শাসক দলের মোকাবিলায় নামিবার পরামর্শ দিয়াছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি শ্রীযুক্ত দিলীপ ঘোষ মহাশয় নিশ্চয়ই আবার বলিবেন, ‘অমর্ত্য সেন কে?’ প্রায় তিন শতক আগে ইংল্যান্ডের কবি ও অধ্যাপক টমাস গ্রে লিখিয়াছিলেন: অজ্ঞতা যেখানে আশীর্বাদ, সেখানে প্রাজ্ঞ হওয়া বোকামি। তবে অধ্যাপক সেনের প্রতি শ্রীঘোষ ও তাঁহার বিবিধ সতীর্থের তীব্র এবং চিৎকৃত বিরাগের ষোলো আনাই অজ্ঞতাপ্রসূত বলিয়া মনে করিলে ভুল হইবে। এই বিরাগের পিছনে রাগও আছে। এবং, মানিতেই হইবে, রাগ করিবার কারণও আছে। নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দলবল এবং তাঁহাদের মত ও পথ সম্পর্কে আপন বিরাগ অধ্যাপক সেন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করিয়া আসিতেছেন। সমালোচকের প্রতি প্রসন্ন থাকিবার জন্য যে উদারতা আবশ্যক, ভারতীয় জনতা পার্টির ধ্বজাধারীদের নিকট তাহা আশা করিলে তাঁহাদের প্রতি অবিচার করা হয়।
কিন্তু শাসক দলের নিজস্ব বলয়ের বাহিরে বৃহত্তর পরিসর হইতেও প্রশ্ন উঠিতে পারে, কেবল শাসক দলের বিরোধিতার জন্যই বিরোধীদের জোট বাঁধিতে হইবে কেন, কোন যুক্তিতে? তেমন জোট বা সমন্বয় কি নেতিবাচক নহে? সেই নেতির সাধনা করিবেন বলিয়া বিরোধীরা নিজেদের বিভেদ সরাইয়া রাখিবেন? সে জন্য নিজ নিজ নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে আপস করিবেন? প্রশ্নগুলি উড়াইয়া দিবার নহে। বরং তাহাদের সদুত্তর খুঁজিবার মধ্য দিয়াই কার্যকর রাজনীতির নিশানা ও রণনীতি নির্ধারণের পথে অগ্রসর হওয়া যায়। সেই সন্ধানের প্রথম দাবি: বাস্তববোধ। রাজনীতি নামক সম্ভাব্যতার শিল্পটিকে বাস্তবের জমিতে দাঁড়াইয়াই নির্মাণ করিতে হয়, রাজনীতি হাওয়ায় হয় না।
অস্বীকার করিবার উপায় নাই, এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব অবস্থাটি বহুলাংশে যাহার সৃষ্টি, তাহার নাম সংঘ পরিবার। নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সরকার তাহার পারিবারিক যজ্ঞে পৌরোহিত্য করিতেছেন। সাত দশক ধরিয়া বহু ঝড়ঝঞ্ঝার মোকাবিলা করিয়া যে উদার, বহুবর্ণ, বহুস্বর গণতন্ত্র গোটা বিশ্বের সামনে স্বাধীন ভারতের অভিজ্ঞান হইয়া দাঁড়াইয়াছে, মোদী-শাহ-ভাগবত মডেলের সহিত তাহার মৌলিক বিরোধ আছে। গত তিন বছর ধরিয়া সেই বিরোধই সহস্রধারায় প্রকট। সংখ্যালঘুর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অত্যাচার, ভিন্নমতের প্রতি চরম ও হিংস্র অসহিষ্ণুতা, বিরোধী দলকে ছলে বলে কৌশলে ভাঙিয়া আপন ক্ষমতা বৃদ্ধির নিরন্তর তাগিদ, সরকার ও দলের অভ্যন্তরীণ পরিসরে সর্বাধিনায়কের একাধিপত্য— প্রত্যেকটি লক্ষণের মূলে রহিয়াছে না-গণতন্ত্রের ব্যাধি। এই ব্যাধি নূতন নহে, সত্তরের দশকে তাহার প্রবল রূপ নাগরিকরা দেখিয়াছেন, পরেও কেন্দ্রে ও নানা রাজ্যে গণতন্ত্র বারংবার লাঞ্ছিত বা খর্বিত হইয়াছে, এখনও হইতেছে, পশ্চিমবঙ্গও তাহার ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু লাঞ্ছিত বা খর্বিত হওয়া এক কথা, বিলুপ্ত হওয়া অন্য। মাত্র তিন বছরের মধ্যে দেশে এমন একটি পরিস্থিতি তৈয়ারি হইয়াছে যে আশঙ্কা হয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের উদার কাঠামোটি টিকিবে তো? এ দেশের সমাজ ও রাজনীতির শক্তি কম নহে, লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাও বিপুল। কিন্তু বিপদও ছোট নহে। সেই প্রেক্ষিতেই বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নটি অ-ভূতপূর্ব গুরুত্ব অর্জন করিয়াছে। বহু বিষয়েই বহু দলের বহু মত থাকিতে পারে। সেই বিভিন্নতার টানাপড়েনের মধ্য দিয়া অগ্রসর হওয়াই রাজনীতির কাজ। কিন্তু যে উদার গণতন্ত্রের কঠিন জমিতে দাঁড়াইয়া সেই কাজটি করিবার, তাহাই যদি ধ্বংস হয়, তবে আক্ষরিক অর্থেই সর্বনাশ ঘটে। অমর্ত্য সেন এই বিপদকেই চিহ্নিত করিয়াছেন।