আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রার্থী ঠিক করিতে রীতিমতো পরীক্ষা লইয়াছে নদিয়ার তৃণমূল কংগ্রেস। কোন প্রকল্পের কী উদ্দেশ্য, তাহার দায়িত্বে কোন দফতর, তাহার উত্তর দিতে হইয়াছে দলের কর্মীদের। পরীক্ষার উপর প্রার্থী চয়ন সত্যই নির্ভর করিবে কি না, সময়ই বলিবে। তবু উদ্যোগটি লক্ষণীয়। যে কোনও কাজে নিয়োগের পূর্বে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বা অপর কিছু যোগ্যতা দেখাইতে হয়। কিন্তু পঞ্চায়েত হইতে সংসদ, রাজনৈতিক প্রার্থীদের যোগ্যতা বিষয়ে বয়স বা নাগরিকত্ব ব্যতীত কোনও শর্ত নেই। কেহ বলিতে পারেন, তাহার প্রয়োজনও নাই। জনজীবনে যথেষ্ট অবদান না থাকিলে, রাজনীতির বোধ যথেষ্ট জোরদার না হইলে রাজনৈতিক দল প্রার্থী করিবে কেন? লোকেই বা ভোট দিবে কেন? কিন্তু গত ছয় দশকে ভারতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের ইতিহাস অন্যরূপ সাক্ষ্য দিতেছে। নির্বাচনে জনসমর্থন পাইবার নানা উপায় আছে, তাহার সবগুলিই প্রার্থীর রাজনৈতিক বোধ বা প্রশাসনিক দক্ষতা দ্বারা নির্ণীত হয় না। বরং স্বচ্ছ ও দুর্নীতিশূন্য রাজনীতির বিচারে যাঁহারা প্রার্থী হিসাবে বাতিল হইতেন, নির্বাচনে তাঁহারাও বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। বর্তমান লোকসভায় মোট ১৮৬ জন সাংসদ, অর্থাৎ ষোড়শতম লোকসভার এক-তৃতীয়াংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ধারায় মামলা রহিয়াছে, এতাবৎকালে যাহা সর্বাধিক। বিধানসভা বা পঞ্চায়েতগুলিতে সমীক্ষা করিলেও ইহার খুব হেরফের হইবে না।
প্রশ্নটা রাজনীতিতে দুষ্কৃতীর আধিপত্যের নহে। প্রশ্ন এই যে, মানুষের প্রয়োজন মিটাইতে তাহাদের প্রতিনিধি কতটা সক্ষম? এলাকার নাগরিকের প্রয়োজন ও চাহিদার বিষয়ে তাহাদের প্রতিনিধির পরিচয় থাকিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। পঞ্চায়েত ও পুরসভার নির্বাচিত সদস্যরা যে হেতু আইন বা নীতি প্রণয়নের চাইতে পরিষেবা দিবার কাজের সহিত ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত, তাই তাঁহাদের জন্য এই বোধ আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ পঞ্চায়েতের প্রধান হইবার দায়িত্ব যাঁহারা সামলাইয়াছেন, তাঁহারাও পরীক্ষায় হোঁচট খাইতেছেন। তাহার অর্থ, পঞ্চায়েতের সদস্যরা পাঁচ বৎসর কাটাইয়াও উন্নয়নের প্রকল্পের সহিত পরিচিত না-ও হইতে পারেন। পঞ্চায়েতে প্রার্থী হইতে যাঁহারা আগ্রহী, তাঁহারা গ্রামে বাস করিয়া, রাজনীতিতে আগ্রহী হইয়াও উন্নয়নের পরিকল্পনা সহিত পরিচিত না হইতে পারেন।
রাজনৈতিক কর্মীদের এই অক্ষমতা পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিবর্তনের প্রতিও ইঙ্গিত করে। গ্রাম পঞ্চায়েতের সূচনা হইয়াছিল বিকেন্দ্রিত স্বশাসনের জন্য, যেখানে গ্রামবাসীরাই স্থানীয় উন্নয়নের পরিকল্পনা করিবেন। তাহার রূপায়ণের দায়িত্ব পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের, কিন্তু নজরদারি করিবেন গ্রামবাসীরাই। আজ এই ব্যবস্থা রহিয়াছে শুধু নামে। উন্নয়নের প্রকল্পের রূপায়ণ প্রায় সম্পূর্ণই নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারি কর্তারা, তাহার কেন্দ্রও গ্রাম পঞ্চায়েত হইতে ক্রমে সরিয়া গিয়াছে ব্লক উন্নয়ন অফিসারের দফতরে। একশো দিনের কাজের তালিকা তৈরি ব্যতীত স্থানীয় উন্নয়নে প্রায় কোনও ভূমিকা নাই পঞ্চায়েতের। তাহার সদস্য নির্বাচন তাই হইয়া দাঁড়াইয়াছে রাজনৈতিক শক্তিপরীক্ষার আরও একটি পালা। উন্নয়নের সঙ্গে পঞ্চায়েতের যোগটি ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে।