পশ্চিমেও চিনের ছায়া দীর্ঘতর

উহান-এর উষ্ণতা তখনও ম ম করছে সাউথ ব্লকের বাতাসে। কয়েক সপ্তাহ হল চিনের সঙ্গে অভূতপূর্ব দীর্ঘ ঘরোয়া সংলাপ শেষ হয়েছে ছবির মতো সুন্দর লেকের ধারে। মোদী সরকারেরও চার বছরের আসন্ন জন্মদিন পালনের বাতাস বইছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ভবনে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করলেন, উহান সংলাপের পর দু’দেশের মধ্যে আস্থা বেড়েছে কয়েক গুণ। সম্পর্কও সহজতর। 

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

উহান-এর উষ্ণতা তখনও ম ম করছে সাউথ ব্লকের বাতাসে। কয়েক সপ্তাহ হল চিনের সঙ্গে অভূতপূর্ব দীর্ঘ ঘরোয়া সংলাপ শেষ হয়েছে ছবির মতো সুন্দর লেকের ধারে। মোদী সরকারেরও চার বছরের আসন্ন জন্মদিন পালনের বাতাস বইছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ভবনে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করলেন, উহান সংলাপের পর দু’দেশের মধ্যে আস্থা বেড়েছে কয়েক গুণ। সম্পর্কও সহজতর।
কথা এবং কাজের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে তার পরের সপ্তাহে চিনের স্টেট কাউন্সিলার ঝাও কেঝি এসে তিন বছর ধরে ঝুলে থাকা নিরাপত্তা চুক্তি সই করলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। সাউথ ব্লক তখন ঘরোয়া ভাবে জানিয়েছিল, এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়াটাই উদ্দেশ্য। ঘটা করে চুক্তি হল। এই আশাও প্রকাশ করা হল যে জইশ-ই-মহম্মদের মাথা মাসুদ আজহারকে নিষিদ্ধ জঙ্গি তালিকাভুক্ত করতে চুক্তি হবে।
এর পর মেকং এবং গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যাওয়ার পরেও দেখা যাচ্ছে, দাঁতে বিষ কমা দূরস্থান, ক্রমশই বাড়ছে। আর আজ গোটা বিশ্বের উদ্বেগ যখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের উপর, তখন সেই চিন কিন্তু এখনও একই ভাবে তামাক খেয়ে চলেছে জইশ-ই-মহম্মদের হাতেই। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে বাঘা দেশগুলির (আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন) আনা মাসুদ-বিরোধী প্রস্তাব এক ভেটোতে বানচাল করে দেওয়ার ক্ষমতাধর এই চিন এখনও একই ভাবে সাউথ ব্লকের রক্তচাপ বাড়াচ্ছে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে যাওয়া প্রস্তাবিত চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) নিয়ে বেজিংয়ের উদ্বেগ (করিডরের নিরাপত্তার অন্যতম রক্ষাকবচ জইশ-নেতাকে চটানো চিনের পক্ষে বিপজ্জনক) অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সর্বঋতুর সখ্যের (‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ডস’) ব্যাপারটা গোপন নয় বিশ্বের কাছে। ভারতের কাছে তো নয়ই। কৌশলগত কারণে সেটি গোপন রাখতে চায়ও না শি চিনফিং সরকার, কারণ এতে ভূকৌশলগত চাপের খেলায় ভারতকে মোকাবিলা করতে তাদের সুবিধা। কিন্তু অতি সন্তর্পণে বাণিজ্যিক এবং রণকৌশলগত এক উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত নতুন এবং গভীর পথ তৈরি করছে বেজিং। সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনার মেঘ কিছুটা কেটে গেলে যা ভারতীয় কূটনীতি এবং বাণিজ্য নীতির প্রশ্নে বড় কাঁটা হয়ে উঠতে চলেছে। চলতি বছরের লোকসভা ভোটের পর দিল্লির মসনদে যে সরকারই এসে বসুক, বিদেশ নীতির এই তিক্ত ব্যঞ্জনটি প্রথমেই তার জন্য পাতে অপেক্ষা করছে।
কী সেটি?
ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (যা নাকি চিনের পক্ষে জরুরি বাণিজ্যপথ) ভিড় বড় বেড়ে গিয়েছে! বেড়ে গিয়েছে আমেরিকার নেতৃত্বে
গড়ে ওঠা সঙ্ঘবদ্ধ নজরদারি। ওই অঞ্চলে আমেরিকার সঙ্গে ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার চতুর্মুখী অক্ষ গড়া বা নৌ সেনা মহড়াই শুধু তো নয়, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো আসিয়ানভুক্ত বেশ কিছু রাষ্ট্রও ভারতের সঙ্গে জোট গড়ে প্রতিরোধ তৈরি করেছে দক্ষিণ চিনা সাগর-সহ এই সমুদ্রপথে চিনা একাধিপত্যের। বার বার বিষয়টি উঠছে আন্তর্জাতিক আলোচনায়। তাতে চিনা বাণিজ্যের বিবিধ খুঁটিনাটি চলে আসছে আতসকাচের নীচে। বাণিজ্যের মোড়কে কৌশলগত আধিপত্য বাড়ানো নিয়ে চিন সম্পর্কে যে অভিযোগ বার বার বহু স্তরে উঠেছে, সেই তত্ত্বটিই পরিবর্ধিত হয়ে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলছে চিনা সরকারকে।
আর তাই ঠিক উল্টো পথে অর্থাৎ পশ্চিমে মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দিকে মসৃণ ভাবে তৈরি করা হচ্ছে এক বিকল্প চিনা বাণিজ্যপথ। ওই ইউরোশিয়া অঞ্চলের মূল পান্ডা রাশিয়ার সঙ্গে এই মুহূর্তে চিনের সম্পর্ক মধুর (যার মধ্যে মিশে রয়েছে আমেরিকার-বিরোধিতার একটি সাধারণ সুর)। ফলে রাশিয়ার কাছ থেকে বাধা পাওয়ার প্রশ্ন অন্তত এই মুহূর্তে উঠছে না। বরং আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে মস্কোকে অনেকটাই নিজেদের বটুয়ায় নিয়ে আসতে পেরেছে বেজিং।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নথি থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই ইউরেশিয়া অঞ্চলটিতে নিজেদের প্রভাব অনেকটাই বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য এক বিরাট মাপের পুঁজি শি সরকার একত্রিত করেছে। কাজে লাগানো হচ্ছে চিন এবং পূর্ব ইউরোপের ১৬টি দেশ নিয়ে গড়া সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশনকে (এসসিও)। লক্ষণীয়, বেশ কিছু পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও (ইইউ) সদস্য। এমন আশঙ্কাও রয়েছে যে এর আগে আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সূক্ষ বিভেদ ঘটিয়ে যে ভাবে ফায়দা তুলে এসেছে চিন, সে ভাবেই ইইউ-তেও বিভাজন তৈরি করতে পারে তারা।
এই ‘পশ্চিম’ অভিযানে চিনের আরও একটি বাড়তি সুবিধা হল জর্জ বুশের সময় যে ভাবে সক্রিয় মধ্য এশিয়া নীতি নিয়ে চলত আমেরিকা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় তা অনেকটাই অন্তর্হিত। মনে করা হচ্ছে, সিরিয়া এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর মার্কিন বুটের ছাপ আরও কমবে ওই এলাকায়। অন্য দিকে চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের প্রধান শরিক হল ইউরেশিয়া অঞ্চল। রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, এবং তাজিকিস্তানে চিন তেল এবং গ্যাসে চুবিয়ে দিতে চলেছে— এমন পরিকল্পনার কথা কানে আসছে ভারতের। গত কয়েক বছরে রেলপথেও ইউরেশিয়ার কিছু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে ফেলেছে চিন। এখনও পর্যন্ত এই অঞ্চলে চিনা সামরিক ঘাঁটি বানানোর কোনও প্রত্যক্ষ তথ্য নেই ঠিকই, কিন্তু হতে কত ক্ষণ!
সব মিলিয়ে এই পশ্চিমপথে সড়ক, রেল এবং জলপথে (কাস্পিয়ান সাগর) অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত জটিল এক তন্তুজাল রচনা করে চলেছে বেজিং, যা অদূর ভবিষ্যতে ভারতের পক্ষে শ্বাসরোধকর হয়ে উঠতে পারে। এই তন্তুজাল কোণঠাসা করে দিতে পারে ভারতের বহুচর্চিত ও বিজ্ঞাপিত ‘প্রসারিত প্রতিবেশ’ (এক্সটেন্ডেড নেবারহুড) নীতিকে। ‘পুবে তাকাও’ নীতি ঘোষণা করার দিব্যদৃষ্টি পেতে মনমোহন সরকারের অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার পর চিনকে সামলাতে হাড় হিম হয়ে গিয়েছে সাউথ ব্লকের। এ বার পশ্চিমেও চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং যোগাযোগ সেতু গড়তে না পারলে অবস্থা অন্য রকম হওয়ার কারণ নেই। নতুন সরকার যারাই গড়ুক, বিদেশ নীতির প্রশ্নে এটা নিঃসন্দেহে এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।

Advertisement

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন