এক সম্প্রীতি-শিবিরে আলাপ হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা জানালেন, ‘আমার-ই এক সহশিক্ষিকা নিজের চায়ের গেলাসটি আমার গেলাস থেকে বেশ খানিক দূরে রাখেন। পাছে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যায়।’ শিক্ষিকাটি ধর্মপরিচয়ে মুসলমান। এখানেই শেষ নয়, ইদানীং অপর-বিদ্বেষী মনোভাবে একটি নতুন মাত্রা হল, এ ধরনের আচরণে পূর্বে যে খানিকটা কুণ্ঠা থাকত, এখন তা উধাও। সদর্পে চলছে সাম্প্রদায়িকতা-অমানবিকতার অনুশীলন। লজ্জা-ঘৃণা-ভয়, তিন থাকতে নয়। সর্বজনিক পরিসরে প্রস্তুতি ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার, অথবা ভূয়সী প্রশংসা সেই ধর্মান্ধ সরকারের, যে সংবিধান-প্রদত্ত ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। ধর্মীয় পার্থক্য থেকে উদ্ভূত বিদ্বেষে পড়ছে সরকারী সিলমোহর। ধর্ম এবং রাজনীতি পৃথক হোক— বলে যে দাবিই করা হোক, সে অবকাশ আর নেই। সমাজবাদী চিন্তক রাম মনোহর লোহিয়ার উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য— রাজনীতি স্বল্পকালীন ধর্ম আর ধর্ম দীর্ঘকালীন রাজনীতি।
আজ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রশ্ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের প্রশ্ন, মানবাধিকারের প্রশ্ন অবান্তর। লাভ-জেহাদ, অ্যান্টি রোমিয়ো স্কোয়াড, কবর বনাম শ্মশান নিয়ে আস্ফালন করেও যদি ক্ষমতায় আসা যায় তখন আর এ-সব প্রশ্ন কেন! একটা গবাদি পশুকে নিয়ে দেশজুড়ে যে কাজটি চলছে, তা প্রথম দিকে হাস্যকর মনে হলেও তার পরিণামে যখন প্রাণের বলি চড়েছে, তখন থমকে দাঁড়াতে হয়। আজকের রাজনীতিতে দীর্ঘ দিনের সহাবস্থানকে মুহূর্তে গুঁড়িয়ে ফেলেছে ধর্মের তুচ্ছ আচারের প্রশ্ন। বোঝা যাছে, সমাজের ভিতরে জমে ছিল বহু অসংগতি, বিদ্বেষ ও দূরত্ব। পাশে থেকেও পড়শিকে জানা-চেনা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩১ সালে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ধর্মমত ও সমাজরীতি সম্বন্ধে হিন্দু-মুসলমান প্রভেদ, এমনকী বিরোধিতা থাকলেও “ভালোরকম করে মেলা চাই। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ আমাদের না হলেই নয়।” কিন্তু মেলানোর চেষ্টাটা গুরুত্ব পায়নি। অন্য দিকে সমান্তরালে চলেছে বিভেদের বীজ বপনের প্রক্রিয়া, আজ যা বিষবৃক্ষ হয়ে পথ আটকেছে। সম্প্রীতি চর্চার সবটাকেই ‘লঘু’ বিষয় মনে করার ফল ফলেছে। এমনকী বড় বাঁধ, পরমাণু কেন্দ্র, কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যাঁরা লড়েছেন, তাঁরাই যে ধর্মের প্রশ্নে একে অপরকে ধ্বংস করতে পিছপা হবেন না— এমনও নজির তৈরি হয়েছে। “আমি হিন্দু নই বলিলে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা যেমন তেমনই থাকিয়া যায়, কেবল আমিই একলা তাহা হইতে পাশ কাটাইয়া আসি”— রবীন্দ্রনাথের এই কথাটাকে আমরা গুরুত্ব দিইনি। ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করা সেকুলার রাষ্ট্র ঘোষণা করে দায় সেরেছি, কিন্তু বিবিধ কার্যকলাপে বিশেষ একটা ধর্মের প্রাধান্য স্বাভাবিক বলে মেনে এসেছি। আসলে মনকে আমরা ফাঁকি দিয়ে এসেছি। পরিণাম, আজকের চর্চায় পৃথিবীর যে কোনও রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ইসলাম ধর্মাবলম্বী নাগরিকের কৃতকর্মের দায় এ দেশের মুসলমানদের উপর বর্তায়।
যে হেতু ধর্মীয় পরিচয় বহনের দায় মেয়েদের উপরেই বেশি থাকে, তাই যে কোনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অধিকারে মুসলমানরা ধর্মীয় কারণে এমনিতেই প্রান্তিক, তার ওপর ‘মেয়ে’ বলে মুসলিম মেয়েদের সুযোগের পরিসর আরও সংকুচিত হয়ে যায়। ইদানীং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, বহু বাধা পেরিয়ে মুসলমান মেয়েরা বিস্তৃত ক্ষেত্রে পা রাখছেন। সেখানে প্রতি মুহূর্তে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য জবাবদিহি করতে হছে। ক্লাসরুমে হিন্দু মেয়েদের সিঁদুর পরা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। কিন্তু মুসলমান হিজাব পরলেই তা সাম্প্রদায়িক।
এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, ধর্মীয় পরিচয়কে মাধ্যম করে যা ঘটছে, তা আসলে রাজনীতি, ক্ষমতা দখলের। রাষ্ট্র-সমাজ-সম্প্রদায় কারও কল্যাণই সেখানে নিহিত নেই। তবু, আমরা মনে করেছি সব ঠিক হয়ে যাবে। ধর্মকে অনুধাবনের চেষ্টা না করেই ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করার ছদ্ম আত্মবিশ্বাসে গর্বিত থেকেছি।
আর যিনি এটা করেছিলেন, জীবন দিয়ে যিনি নিজের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে রক্ষা করেছেন, তাঁকে আমরা দূরে সরিয়ে রেখেছি। কিন্তু তাঁর হাত এখনও আমাদের দিকে বাড়ানো। ১৯৪৮-এ সাম্প্রদায়িকতার বিষ তাঁর প্রাণ কেড়েছে, কিন্তু তাঁর চিন্তা এতই শক্তিশালী যে, ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীরা আজ তাঁর অস্তিত্বকেই সহ্য করতে পারছে না। বহু জনকে সঙ্গে নিয়ে চলার প্রতীক এই মানুষটি ভারতে বহু ধর্মের অবস্থানকে এড়িয়ে যাননি, তাকে বুঝতে চেয়েছেন, সম্মান করেছেন। নিজেকে সনাতনী হিন্দু বলে দাবি করেই বাদশা খান ও দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে পথ হেঁটেছেন। তিনি একটি যাপন দেখিয়েছিলেন, যেখানে মেলা যায়, মেলানো যায়। ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি নয়, রাজনৈতিক ধর্ম মেনে চলতে হয়। মনে রাখতে হবে শেষ পর্যন্ত তিনি কিন্তু ছিলেন এক জন রাজনৈতিক মানুষ। আজ গান্ধীর সেই রাজনৈতিক ধর্মাচরণটাই পথ হতে পারে। যদি আমরা এখনও শেখার জন্য প্রস্তুত থাকি, তা হলে ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের চেয়ে অনেক বেশি জোর দেব রাজনীতির নিজস্ব ধর্মের উপর। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নামক ঘোর শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে মহাত্মার চেয়ে বড় সহায় কেউ নেই।