সম্পাদকীয় ১

প্রতিবেশীর ভূমিকা

শ্রীলঙ্কার এলটিটিই যুগে পলাতক তামিলদের আশ্রয়দান, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দান ইত্যাদি দেখায়, ভারত ইতিপূর্বে প্রতিবেশী দেশের বিতাড়িত জনতার জন্য নানারূপ স্থায়ী বা অস্থায়ী বন্দোবস্ত করিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

একটি আশ্চর্য জটিল সংকট তৈরি হইয়াছে এশীয় ভূখণ্ডে, যে সংকটের সামান্য সুরাহার আশায় অনেকেই গত কয়েক দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর দিকে তাকাইয়া ছিলেন। মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সে দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতনের সংকটটি ইতিমধ্যেই সর্বজ্ঞাত: গত কয়েক মাসে এই সংকট এক অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে। হাজার হাজার জনতা প্রাণভয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া ভিটেমাটি এবং দেশ ছাড়িয়া পলায়মান, এই ছবি গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ছাইয়া ফেলিয়াছে। তাহাতে অবশ্য সংকটের বিন্দুমাত্র উপশম হয় নাই। আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হইয়া বহুসংখ্যক উদ্বাস্তু প্রবেশকে স্বীকৃতিদান এমনিতেই বিতর্কযোগ্য। তদুপরি রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ায় তাঁহাদের কপালে জুটিতেছে অতিরিক্ত অভিযোগ, এমনকী জঙ্গি অনুপ্রবেশকারীর তকমাও। সুতরাং ভারত ও বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাহাদের দরজা বন্ধ করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। তাড়নাকারী স্বদেশ এবং অতি-অনাগ্রহী প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে পড়িয়া রোহিঙ্গা আবালবৃদ্ধবনিতার সংকট যখন তুঙ্গে, সেই সময়ই মায়ানমারে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করিতে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ঠিক এই মুহূর্তে তাঁহার সে দেশে যাইবার তেমন কোনও বাধ্যতা ছিল না, তবু যখন তিনি গেলেন, তাঁহাকে ঘিরিয়া একটি আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা তৈরি হইল। কিন্তু মোদী ফিরিয়া আসিয়াছেন সব প্রত্যাশায় জল ঢালিয়া, মায়ানমারের প্রধানমন্ত্রী অং সান সু চি-র সহিত তাঁহার আলোচনায় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিই উত্থাপিত হয় নাই। উপদ্রুত রাখাইন প্রদেশের উল্লেখ করিয়া কেবল কিছু রাষ্ট্রিক শুভেচ্ছা বিনিময় ঘটিয়াছে মাত্র।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বলিতে পারেন, মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের দায় তাঁহার দেশ লইবে কেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতিতে ইহার উত্তর আছে। কোনও রাষ্ট্র হইতে বিতাড়িত জনতাকে পুনরায় বিতাড়ন করা যায় না, যদি নিজ রাষ্ট্রে তখনও তাহার উপর নির্যাতনের সম্ভাবনা থাকে। ভারতের ইতিহাসেও এই ‘কেন’র কিছু উত্তর পাওয়া সম্ভব। শ্রীলঙ্কার এলটিটিই যুগে পলাতক তামিলদের আশ্রয়দান, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দান ইত্যাদি দেখায়, ভারত ইতিপূর্বে প্রতিবেশী দেশের বিতাড়িত জনতার জন্য নানারূপ স্থায়ী বা অস্থায়ী বন্দোবস্ত করিয়াছে। সুতরাং জম্মু ও কাশ্মীরে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার যে নিষ্পত্তিই হউক, সীমান্তবর্তী অসহায় পলাতক জনতার জন্য অন্তত কিছু অস্থায়ী শিবিরের আয়োজন হয়তো নীতিগত ভাবে অসম্ভব ছিল না। আসল কথা, দ্রুত হাত ধুইয়া ফেলিবার প্রয়াসের পিছনে ভূরাজনৈতিক হিসাব একটি বড় কারণ: মায়ানমারের সহিত মোদীর নূতন মিত্রতা তৈরির তাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের সহিত টক্কর দিবার লক্ষ্যেই, এবং সু চি-র দেশে ভারতের অর্থনীতির উপঢৌকনের সহিত কূটনীতির রংমিলান্তির প্রয়োজনও সেই কারণেই বিরাট।

ভারতের বর্তমান রোহিঙ্গা নীতির মূলে কূটনীতির সহিত কিছু রাজনীতির হিসাবও মিশিয়া থাকিতে পারে। সামান্য অজুহাতে যে ভাবে এই উদ্বাস্তুদের জঙ্গি বলিয়া দাগাইয়া দেওয়া হইতেছে, তাহার পিছনে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুমান করা সম্ভব। অপরিসীম দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এত বড় একটি মানবাধিকার সংকট এত দ্রুত ধর্মপরিচিতির ভিত্তিতে আলোচিত হইতে শুরু করিয়াছে, এবং কূটনীতির দাবার চাল আপাতত ধর্মরাজনীতির ভাষায় চালিত হইতেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ছাড়া এশিয়ার কোনও দেশ বিষয়টি লইয়া সহানুভূতি দেখাইতে রাজি নহে, এমনকী প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সামান্য পরোক্ষ ভর্ৎসনা করিতেও তাহারা রাজি নহে। বাস্তবিক, মায়ানমারের গৃহহীন ধর্ষিত লুণ্ঠিত রোহিঙ্গারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বন্ধুহীন উদ্বাস্তু।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন