সম্রাট কিংবা মার্শাল পুতিন

ভাঙাভাঙিটা কি তবে আমাদেরই ধারা? মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবির প্রথম দৃশ্যটা মনে পড়তে পারে। লাটসাহেবদের ব্রোঞ্জমূর্তি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন সে সব সবার চোখের আড়ালে রয়েছে ব্যারাকপুরের লাটবাগানে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের স্মৃতি যাঁদের টাটকা, তাঁরা আজও আপশোস করেন অনুপম স্থাপত্যশৈলীর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউসের জন্য।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

খবরে জেনেছি, সিপিএম-এর নভেম্বর বিপ্লবের উৎসব ঘিরে ত্রিপুরায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিজেপি। মাসকয়েক আগে বেলোনিয়ায় বুলডোজ়ার দিয়ে লেনিন মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা তো শুনেছি বটেই। মস্কো থেকে কিছু দূরে সেরগিভ পসাড শহরে হাঁটতে হাঁটতে এই সব নানা কথা মাথায় ঘুরছিল। স্বাভাবিক। সেরগিভ পসাড শহরটা প্রায় রাশিয়ার ধর্মতান্ত্রিক রাজধানী। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের কেন্দ্রটি এখানে। গাইড বললেন, ১৯২০ সালে চার্চে তালা দিয়ে দেয় সোভিয়েত সরকার, সাধুদের সরিয়ে ঠাঁই দেওয়া হয় সাধারণ মানুষকে। ১৯৪৫-এ আবার খোলে চার্চ। না, সোনায় মোড়া ক্যাথিড্রাল চত্বরে কোনও ধ্বংসলীলা চলেনি। বরং তাকে মিউজ়িয়াম বানানোর পরিকল্পনা হয়েছিল! মস্কোও তেমনই: সোভিয়েত পতনের পর ছাব্বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তার বুকে বিরাশিটা লেনিনমূর্তি। কিছু স্ট্যালিনেরও (ছবি)।

Advertisement

ভাঙাভাঙিটা কি তবে আমাদেরই ধারা? মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবির প্রথম দৃশ্যটা মনে পড়তে পারে। লাটসাহেবদের ব্রোঞ্জমূর্তি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন সে সব সবার চোখের আড়ালে রয়েছে ব্যারাকপুরের লাটবাগানে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের স্মৃতি যাঁদের টাটকা, তাঁরা আজও আপশোস করেন অনুপম স্থাপত্যশৈলীর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউসের জন্য। ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’য় দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন— “বাংলাদেশে নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির মৃত্যু অনেক দিন হয়েছিল। এবার তার কবরটাও ভেঙে গেল।”

আশ্চর্যই বলতে হয়, এত ঘটনাবহুল ইতিহাসের পরও রাশিয়ায় তত দ্বন্দ্ব নেই, যে যার মতো রয়েছে। রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, কিন্তু জ়ারদের ইতিহাস রক্ষায় কমিউনিস্টরা যত্নবান ছিল বলতে হবে। ইম্পিরিয়াল হিস্ট্রির মিউজ়িয়াম ও ক্যাথিড্রালের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল নিকোলাসের হত্যাকারীরা। উইন্টার প্যালেসে জ়ারদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল রেমব্রাঁ, দা ভিঞ্চি: তাকে সমৃদ্ধ করে সোভিয়েত আমলে নিয়ে আসা হয় পিকাসো, মাতিস। সেই মিউজ়িয়ামকেই আরও সাজাচ্ছে আধুনিক রাশিয়া।

Advertisement

সেন্ট পিটার্সবার্গের উত্তর শহরটা জ়ারদের তৈরি। নেভা নদীর পাড় ধরে সুসজ্জিত অট্টালিকার সারি। স্ট্যালিনীয় স্থাপত্যে কমিউনাল অ্যাপার্টমেন্ট দক্ষিণে। নিজেরটা গড়তে অন্যেরটা ভাঙেনি এরা।

ভ্লাদিমির শহরে আমাদের গাইড ক্যাথরিন গল্প বলছিলেন জ়ার চতুর্থ ইভান ভ্যাসিলিয়েভিচ-এর। বলা হল, আইজ়েনস্টাইনের ‘ইভান দ্য টেরিবল’ ছবির সূত্রে আমরা তাঁর কথা জানি। একটু হতাশ হয়ে বললেন, “আইজ়েনস্টাইন ইজ় ভেরি পলিটিক্যাল।” বুঝলাম, সোভিয়েত না-পসন্দ। ভ্লাদিমির পুলিশের সদর দফতরের পুরনো বাড়ির মাথায় কাস্তে-হাতুড়ি-তারা সরানো হয়নি কেন? গাইডের উত্তর, “সরাবে কেন? ওটা তো ইতিহাস।”

জ়ার থেকে সোভিয়েত, সোভিয়েত থেকে গণতন্ত্র— ইতিহাসের পর্বগুলি যতটা উত্তেজনাময় বলে মনে হয়, রাশিয়ার সাধারণ মানুষ কিন্তু তার চেয়ে সহজ করেই বলেন। দেশ শাসন করত একটা পরিবার; যা ধনসম্পদ তৈরি হত, সবই তাদের হাতে চলে যেত। তার পর এক দিন গরিবদের নিয়ে লড়াই করে ক্ষমতায় এসে বলশেভিকরা বলল, এ বার থেকে সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের। অভিজাতদের বাড়িগুলো বিলিয়ে দেওয়া হল গরিবদের মধ্যে। সকলে খাওয়া-পরার সুযোগ পেল। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবহণ থেকে ঘর গরম করার ব্যবস্থা, মিলল প্রায় বিনামূল্যেই। তবে সব সম্পদ আসলে জড়ো হল পার্টির হাতে। কিছুটা গেল বিশ্বের নানা কমিউনিস্ট পার্টিতে। ধীরে ধীরে অর্থনীতি থমকে গেল, ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ব্যবস্থা। পুরনো সম্পত্তি দাবি করার জন্য সবাইকে একটা করে ভাউচার দেওয়া হল। সাধারণের হাতে টাকা ছিল না বলে কিছু বড়লোক সব ভাউচার কিনে নিল। তবু এখন যেন জনসাধারণও দেশের সম্পদের ছোঁয়া কিছুটা পাচ্ছে। মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট, গাড়ি কিনছে। ভোগ করতে শিখছে। এ-ই হল ব্যাপার।

ভ্লাদিমির পুতিনের সাফল্যও এখানেই। পুরো ব্যাপারটাকেই সহজ ভাবে রেখে দিয়েছেন এই শাসক। যা গিয়েছে, তা-ও রয়েছে দলিলের মতো। গাড়ির চালক ওলেগ বলছিলেন, “কমিউনিস্টদের সমর্থন এখনও ভাল। বিশেষত বৃদ্ধদের মধ্যে। ওঁরা সেই সময়ের সামাজিক সুরক্ষাগুলো পেয়েছেন। শেষ ভোটে ১৭ শতাংশ ভোট পেল কমিউনিস্টরা। ওরাই প্রধান বিরোধী দল।” বললাম, “ভোটে খুব রিগিং হয়েছে শুনলাম। না হলে কমিউনিস্টরা আরও বেশি ভোট পেত, তাই না?” “না তো! ভুল জেনেছ। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বানানো কথা। পুতিনের এমনিই জনসমর্থন আছে। সামান্য কিছু রিগিং হয়ে থাকলেও ওটা বড় ব্যাপার নয়।”

এই ওলেগ কিন্তু পুতিনভক্ত নন। বরং তাঁকে ‘জ়ার’ বলে কটাক্ষ করেন। বলেন, সকলে ভাল থাকতে গেলে ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারির ‘অসমাপ্ত’ বিপ্লবটা শেষ করতে হবে। তবু তাঁর মতে, পুতিন কাউকে সে ভাবে চেপে দিচ্ছেন না।

শুনে এসেছিলাম, ২০১৭-এ বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষ নিয়ে হইচই চাননি প্রেসিডেন্ট পুতিন। ঠিকই। রাষ্ট্রীয় হইচই হয়নি। কিন্তু রাশিয়া গিয়ে জানলাম, গত বছর ৮ নভেম্বর রেড স্কোয়্যারে কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন। আর সেন্ট পিটার্সবার্গের স্টেট হার্মিটেজ মিউজ়িয়াম দেখলে কে বলবে যে সোভিয়েত আর নেই? দেওয়াল জুড়ে লেনিনের ছবি, সোভিয়েতের প্রোপাগান্ডা পোস্টার।

জ়ারদের প্রাসাদগুলিকে সংগ্রহশালায় পরিণত করেছিল সোভিয়েত। তেমনই লেনিন বা স্ট্যালিনের অফিস, বলশেভিক পার্টির পলিটবুরো কার্যালয় কিংবা নিউ ক্রেমলিনকে পর্যটকদের জন্য সাজিয়ে দিয়েছে পুতিন সরকার। আর লেনিনের মওসোলিয়ম? ক্রেমলিনের গায়ে এই স্মৃতিসৌধ নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে জ়ারপন্থীদের, অর্থোডক্স চার্চেরও। কিন্তু রুশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান জানিয়েছেন পুতিন রেড স্কোয়্যারে ‘কোনও বর্বরতা’ চান না। কেজিবি-র প্রাক্তন কর্নেলের এই সিদ্ধান্তের হরেক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হয়েছে। তবে রাশিয়ার ঐতিহ্য এটাই। সুচতুর পুতিন সেটা জানেন।

কিছু বিপরীত ছবিও আছে। স্ট্যালিনের আমলে ১৯৩০-এ ট্রিনিটি লাভরার জ়ার বেল-সহ বেশ কিছু মূল্যবান জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই একই সময় হার্মিটেজ মিউজ়িয়ামের কিছু পেন্টিংও নিলাম হয়ে যায়। ২০০৯ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের সব চেয়ে বিখ্যাত লেনিন মূর্তির বেশ কিছু অংশ বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা।

সাধারণ মানুষ আজও দুই শাসকের নাম খুব করে থাকেন— জ়ার বা সম্রাট, এবং মার্শাল স্ট্যালিন। যাঁরা বিশ্বের সামনে রাশিয়ার ক্ষমতা তুলে ধরতে পেরেছিলেন, তাঁরাই আজও হিরো। পুতিনও পারছেন। সিরিয়ার যুদ্ধে তাই রুশবাসী অখুশি নন। মার্কিনদের সঙ্গে একটা টক্কর দেওয়া যাচ্ছে, ভালই তো! আসল রুশ মেজাজটা ধরা পড়ল ওলেগের একটা মন্তব্যে। জানতে চেয়েছিলাম, “ইংরেজি বলতে তোমাদের এত অনীহা কেন?” ওলেগের সটান উত্তর, “বিকজ় উই আর নট কলোনি। উই আর এম্পায়ার। অলওয়েজ় এম্পায়ার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন