ঐতিহ্য নয়, নিছক কুসংস্কার

এই সে দিনও সব বয়সের মেয়েরাই শবরীমালার মন্দিরে ঢুকতেন

শবরীমালা হল এই ধারার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লাগাতার আলোচনা চলছে বটে, কিন্তু অনেকেই সমস্যার মূল চরিত্রটি ঠিক ধরতে পারছেন না।

Advertisement

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১৩
Share:

সংঘর্ষ: মাধবী ও তাঁর পরিবারকে ভক্তরা বাধা দেওয়ায় পুলিশ প্রহরায় তাঁদের শবরীমালার পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ১৭ অক্টোবর। পিটিআই

কখনও মুসলমান বা দলিতদের উপর নারকীয় অত্যাচার, কখনও আধার কার্ড নিজস্ব পরিসরের অধিকার লঙ্ঘন করে কি না সেই প্রশ্ন, কখনও বা সমকামিতার অনুমোদন— থেকে থেকেই একটা না একটা বিষয়ে দেশের জনমত আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে, এবং তা নিয়ে ভয়ানক সংঘাত ঘটছে। তিন তালাক কিংবা জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়গুলি নিয়েও পরিকল্পিত বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, কারণ তাতে কারও না কারও ভোট বাড়ে। বিষয় পাল্টায়, স্থান বদলায়, কিন্তু বিরোধী মতগুলির দ্বন্দ্ব এমন তিক্ত হয়ে ওঠে যে মনে হয় যেন আদর্শগত গৃহযুদ্ধ চলছে।

Advertisement

শবরীমালা হল এই ধারার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লাগাতার আলোচনা চলছে বটে, কিন্তু অনেকেই সমস্যার মূল চরিত্রটি ঠিক ধরতে পারছেন না। গোটা ব্যাপারটা দেখে ধাঁধা লাগা স্বাভাবিক। এক দিকে যখন বহু মহিলা (এবং পুরুষ) পবিত্র মন্দিরে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য কট্টর পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তখন অন্য দিকে বহু মহিলা ও পুরুষ সেই অধিকারের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছেন, সর্বোচ্চ আদালত সেই অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও। এটা আরওই বিস্ময়কর ঠেকতে পারে, কারণ মেয়েদের ক্ষমতায়ন, সাক্ষরতা এবং অন্য নানা বিষয়ে কেরল হল দেশের সব চেয়ে প্রগতিশীল রাজ্য। রাজনৈতিক দলগুলি যে এই পবিত্র ঘোলাজলে ঝাঁপ দিতে কালক্ষেপ করেনি, সেটা অবশ্য প্রত্যাশিতই ছিল।

প্রসঙ্গত, শবরীমালা বা শবরীমালাই হল পাহাড়ের নাম, দেবতার নয়। দেবতা হলেন শাস্তা আয়াপ্পন। নামের দু’টি অংশই তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্ম-শাস্তা হল মালয়ালিতে বুদ্ধের একটি নাম— এই ধারণা বহুলপ্রচলিত যে, এখানে আদি দেবতা ছিলেন বৌদ্ধ। এখনও তীর্থযাত্রীরা সারা পথ ‘শরণম্’ বলতে বলতে যান। অন্য নামটি (আয়াপ্পন) এসেছে সুপ্রাচীন দ্রাবিড় ঈশ্বর ‘আই’ থেকে। আয়ানার হলেন তামিল লোকদেবতা। পুরুষ্টু গোঁফজোড়া নিয়ে প্রত্যেক গ্রামের বাইরে তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে দ্বাররক্ষী হিসেবে বিরাজ করেন, হাতে খোলা তরোয়াল। তাঁর বংশধারা এতটাই অনার্য যে, আঠারোটি মহাপুরাণের একটিতেও তাঁর উল্লেখ নেই, তবে ভূতনাথ-উপাখ্যানম্ নামক স্থানীয় উপপুরাণে তাঁর মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে— স্পষ্টতই এটা হল তাঁকে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ধারায় তুলে আনার প্রকল্প। এর ফলে নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের কাজটা সহজ হয়ে যায়। এঁরা অষ্টম শতকে কেরলে আসেন, সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি থেকে মন্দির ও আরাধনা অবধি সব কিছুর সংস্কৃতায়ন ঘটানোই ছিল এঁদের লক্ষ্য। শবরীমালার শাস্তাকে এই উদ্দেশ্যেই আই-এর মাধ্যমে আয়াপ্পন-এ পরিণত করা হল। আয়াপ্পন হলেন পান্ড্য রাজত্বের এক অকুতোভয় রাজকুমার, শিবের সঙ্গে মোহিনী মূর্তিধারী বিষ্ণুর মিলনে তাঁর জন্ম। মনে পড়বে কেরলের মোহিনীঅট্টম নৃত্যের কথা, যা এখন একটি ‘জাতীয় ধ্রুপদী নৃত্যকলা’ হিসেবে স্বীকৃত। আয়াপ্পন মহিষাসুরী নামক মহিষ-রূপিণী দেবীকে পরাজিত করেন, সকলের ত্রাস সৃষ্টিকারী দস্যুরাজ উদয়নমও তাঁর হাতে পরাজিত হন। তার পর তিনি শবরীমালা মন্দিরে সসৈন্য বিজয় অভিযান করেন, সেখানে আঠারোটি পবিত্র সোপান অতিক্রম করে ওঠেন। কিন্তু বিগ্রহের কাছে আসতেই তিনি অলৌকিক ভাবে দেবতা শাস্তার দেহে লীন হয়ে যান। এই ভাবে, এক লহমায় কেরলের সব চেয়ে জনপ্রিয় লোকদেবতার ব্রাহ্মণায়ন সম্পূর্ণ হয়। তবে শাস্তা-আয়াপ্পনের আরাধনার অনেক রীতি এবং আচারই আজও রীতিমতো অ-সংস্কৃত।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিতর্কের মধ্যেই শবরীমালায় যেতে চান অমিত শাহ

প্রতি বছর কেরলের সমস্ত অঞ্চল থেকে সমস্ত জাতি ও শ্রেণির কোটি কোটি ভক্ত শবরীমালা পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হয়ে দুর্গম পথে মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বছরের খুব অল্প সময় মন্দির খোলা থাকে। পেরিয়ার টাইগার রিজ়ার্ভ নামক অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে এই তীর্থযাত্রায় এমনকি মুসলমান এবং খ্রিস্টানরাও যোগ দেন, যা থেকে বোঝা যায় তার মৌলিক সর্বজনীন চরিত্র। বস্তুত, মন্দির চত্বরেই আছেন এক মুসলিম দেবতা, তাঁর নাম ভাভার, আবার অধিকাংশ তীর্থযাত্রী কাছেই আর্থুঙ্কল গির্জায় আশীর্বাদ চাইতে যান।

এ যাবৎ মেয়েদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি বয়সিরাই মন্দিরে ঢুকতে পারতেন। পনেরো থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি মেয়েরা কেন প্রবেশাধিকার পাবেন না, এই নিয়েই বিবাদ চলছে। এঁদের অভিহিত করা হচ্ছে ‘ঋতুস্রাবের বয়সের নারী’ নামে, সন্তানের জননীদের অভিধা হিসেবে যা এক কথায় ভয়াবহ। তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে মনে রাখা দরকার, শবরীমালার সমস্ত তীর্থযাত্রীকেই অত্যন্ত কঠোর কিছু নিয়ম পালন করতে হয়, যেমন যাত্রা শুরুর আগে টানা ৪১ দিন আমিষ ভক্ষণ নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ মদ্যপান, অনেকের পক্ষেই যা রীতিমতো কঠিন। ও হ্যাঁ, এই সময়টাতে যৌনসংসর্গও নিষিদ্ধ।

আরও পড়ুন: দীপাবলির ছুটিতে আর ফেরা হল না ভব্যের

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের ডিভিশন বেঞ্চ একটি মামলার নিষ্পত্তি করে রায় দেন যে, শবরীমালায় আয়াপ্পনের মন্দিরে দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি মেয়েদের প্রবেশের অধিকার প্রত্যাখ্যান করা চলবে না, কারণ তাতে সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে। একটু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওই বেঞ্চের একমাত্র মহিলা বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের বিপক্ষে মত দান করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়টি প্রত্যাশিত ভাবেই সাধারণ ভাবে জনমতের প্রবল সমর্থন পায়, কিন্তু গুরুস্বামী নামে পরিচিত শবরীমালার প্রধান পুরোহিতরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেন, এতে ‘ঐতিহ্য’ লঙ্ঘিত হবে। আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই মতই পোষণ করেন। তাঁদের মতে, আয়াপ্পন হলেন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী, ‘ঋতুস্রাবের বয়সের মেয়েরা’ মন্দিরে ঢুকলে তাঁর ‘পবিত্রতা’ লাঞ্ছিত হবে। যে হিন্দুত্ববাদীরা সম্প্রতি তিন তালাক সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেছিলেন যে, এর ফলে মুসলিম মেয়েরা একটা বড় স্বাধিকার পেলেন, তাঁরাই এখন বলছেন, যে প্রথার পক্ষে ধর্মীয় অনুমোদন আছে তা ‘অন্যায়’ বলে প্রতিভাত হলেও আদালতের সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। কিন্তু তারা বলছে, এই কুসংস্কারমূলক প্রথাটি আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। এই কথাটা মোটেই ঠিক নয়। ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত নির্ধারিত বিধিনিয়মগুলি পালন করলে যে কোনও বয়সের মেয়েরাই মন্দিরে ঢুকতে পারতেন। ১৯৫০ সালে ওই মন্দিরে একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে, এবং তার পরেই কুসংস্কারের এক বিচিত্র লীলা শুরু হয়। নথিপত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালে কেরলের হিন্দু আরাধনাস্থলে প্রবেশ অনুমোদন সংক্রান্ত আইন পাশ হওয়ার পরেও সব বয়সের মেয়েরাই, অল্প সংখ্যায় হলেও, মন্দিরে ঢুকেছেন। আসল সমস্যা বাধে ১৯৮৩ সালের পরে। সেই বছর ওই এলাকায় একটি পাথরের ক্রুশ আবিষ্কৃত হয় এবং খ্রিস্টানরা মহাদেবের মন্দিরের কাছে নিলাক্কল-এ একটি গির্জা তৈরি করেন। মন্দিরের পুরোহিতদের নেতৃত্বে এক জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালে কেরল হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় যে, দশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সি মেয়েরা এই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন না। আটাশ বছর পরে সুপ্রিম কোর্ট আবার সেই বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছে। এক কথায় বললে, এটা সনাতন ধর্মের কোনও ব্যাপারই নয়, যদিও ওই ধর্মের নাম করে যাঁরা রাজনীতি করেন, এই সমস্যাটি তাঁদের কেরলে পা রাখার একটি সুযোগ করে দিয়েছে, যে কেরল তাঁদের এ যাবৎ বিশেষ পাত্তা দেয়নি।

একটা কথা মনে রাখা দরকার। ঋতুস্রাব হল মেয়েদের সৃষ্টিশক্তির প্রতীক। এই প্রতীকের বন্দনা করার বদলে পিতৃতন্ত্র চিরকাল দুনিয়া জুড়ে একে হীন প্রতিপন্ন করতে তৎপর থেকেছে। প্রসঙ্গত, কেরলে আলাপুজা-র কাছে চেঙ্গানুর-এ একটি মন্দির আছে, যেখানে দেবীর ‘নিয়মিত ঋতুস্রাব’ হয়। ভারত যুগ যুগ ধরে মাতৃদেবীর আরাধনা করে এসেছে। এই দেশ মানবজাতির সুরক্ষায় মেয়েদের প্রজননশক্তির বন্দনা করবে, না বোধহীন, সংবেদনহীন তালিবানদের মতো তাকে ছোট করবে— সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন