চার-পাঁচ দিন শবরীমালার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, অক্লেশে

লোকধর্মের গণতন্ত্র

ঐতিহ্য, কেন না সমাজ মেনে নিয়েছে। আয়াপ্পার এক পূজারি বলেছিলেন, শবরীমালার নতুন মন্দিরটি তন্ত্রমতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তাই মেয়েদের ঢোকা বারণ। বামাচারী তন্ত্রে অবশ্য মেয়েদের গুরুত্ব আরও বেশি হওয়ার কথা। 

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:১১
Share:

কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! গত সপ্তাহে শবরীমালা তীর্থক্ষেত্রে ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, নারীবাদী থেকে ঐতিহ্যবাদী, মনুবাদী থেকে প্রগতিবাদী সকলে নিজের নিজের কথা বলে যাচ্ছেন। কেউ পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করছেন না। অতএব, জনসমাজে হেলদোল নেই। অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, কর্নাটক থেকে বাসবোঝাই পুণ্যার্থীর ভিড়ে উত্তরযৌবনা এবং বাবার হাত-ধরা বালিকারাও আছেন। জঙ্গলের পথে তাঁরা কোনও বাধা ছাড়াই এগিয়ে চলেছেন।

Advertisement

প্রথমে প্রগতিবাদীদের কথায় আসা যাক। তাঁদের সাফ বক্তব্য, আইনের চোখে সকলে সমান। বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট যখন সকলের প্রবেশাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছে, ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সি রজোযোগ্য মহিলাদের মন্দিরে যেতে না দেওয়া সংস্কারের নামান্তর। প্রগতিবাদীরা কেউ কেউ স্পষ্ট দেখিয়েছেন, ১৯৫০ সালে চোরাশিকারিদের হাতে প্রাচীন মন্দিরটি আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার সময়েও মেয়েদের প্রবেশ নিষেধের এই শর্তটি ছিল না। নতুন মন্দির হওয়ার পরই উদ্ভট এই নারীবিরোধী অনুশাসন। সেটাকেই এখন ঐতিহ্যের তকমা দেওয়া হচ্ছে।

ঐতিহ্য আকাশ থেকে পড়ে না। তৈরি করা হয়। কেরল বহু দূর, আমাদের হাতের কাছেই আছে বারাণসী শহর। সেখানে দশাশ্বমেধ ঘাটে ফি সন্ধ্যায় গঙ্গারতি নতুন ঐতিহ্য। ইংরেজ আমলে গোদাবরী বলে ছোট্ট একটা নদী বুজিয়ে গোধুলিয়া মোড় নামে এক রাস্তা তৈরি হয়, তার পরই ওই ঘাটের গুরুত্ব বাড়ে। আগে গঙ্গার ধারে একটাই শ্মশান ছিল: হরিশচন্দ্র ঘাট। মুঘল আমলের শেষ দিকে সেখানে কাশ্মীরীমল্ল নামে এক বণিক তাঁর রক্ষিতার সৎকার করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডোমরা রাজি হননি। কাশ্মীরীমল্ল তখন মনিকর্ণিকায় তাঁকে দাহ করেন, ঘাটের অন্য মর্যাদা তৈরি হয়। এখন গল্পটা বিস্মৃত, কিন্তু মনিকর্ণিকার শ্মশান ঐতিহ্য!

Advertisement

ঐতিহ্য, কেন না সমাজ মেনে নিয়েছে। আয়াপ্পার এক পূজারি বলেছিলেন, শবরীমালার নতুন মন্দিরটি তন্ত্রমতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তাই মেয়েদের ঢোকা বারণ। বামাচারী তন্ত্রে অবশ্য মেয়েদের গুরুত্ব আরও বেশি হওয়ার কথা।

কিন্তু পুরোহিতের এক কথা, ‘না, তন্ত্র মেয়েদের পক্ষে বিপজ্জনক।’

বিশ্বাসে মিলায় শবরী, তর্কে বহু দূর! মন্দিরের দেবতা আয়াপ্পা। তিনি কে? বিষ্ণু যখন মোহিনী নারীর বেশ ধরে দৈত্যদের থেকে অমৃত নিয়ে এলেন, শিব তাঁকে দেখে উত্তেজিত হলেন। শিব আর মোহিনী বিষ্ণুর মিলনে জন্মালেন আয়াপ্পা! তৃতীয় লিঙ্গ, বিকল্প যৌনতার অধিকারের জন্য শবরীমালাকে লড়তে হয়নি, সেটি তার পুরাণকথাতেই আছে। তীর্থযাত্রীরা পাহাড়ি পথে পরস্পরকে ‘স্বামী’ বলে সম্বোধন করেন। ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সবাই স্বামী। এর পরও বলব, শবরীমালায় নেই সমান অধিকার!

এই গণতন্ত্রে মানুষ থেকে জঙ্গলের পশুপাখি সকলের সমান অধিকার। পেরিয়ার টাইগার রিজ়ার্ভের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। গাছের গায়ে বাঘের ছবি, নীচে লেখা, ‘আয়াপ্পার বন্ধুদের রক্ষা করুন।’ আয়াপ্পা মানবশিশু রূপে পম্পা নদীতে ভাসছিলেন, পান্ড্যলাম রাজ্যের রাজা রাজশেখর তুলে এনে মানুষ করেন। রানি অবশ্য দুষ্ট মন্ত্রীর প্ররোচনায় বিপথে চালিত হলেন। বায়না ধরলেন, তাঁর শরীর খারাপ। বাঘের দুধ খেলে অসুস্থতা সারবে। বালক আয়াপ্পা গেলেন জঙ্গলে। মহিষী নামে এক দানবীকে বধ করলেন, ফেরার পথে স্বর্গের দেবতারা বাঘের রূপ ধরে তাঁর সঙ্গী হলেন। আয়াপ্পা মন্দিরের প্রবেশপথে তাই বাঘের পিঠে আয়াপ্পার ছবি। বাস্তুতন্ত্র, অরণ্য সংরক্ষণের পশ্চিমি বয়ানের ঢের আগে দক্ষিণ ভারতের জনসমাজে এই গল্প চালু। সেটি জানতে হবে। ইতিহাস মানে শুধু পঞ্চাশের দশক এবং অধিকার রক্ষার আন্দোলন নয়, মিথগুলিও জানতে হয়। ইতি-হ-আস মানে, এই রকমই ছিল!

আয়াপ্পা-সংস্কৃতি মিথের স্বর্ণখনি। শবরীমালা পাহাড়ের আয়াপ্পা নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী। সেখানে তীর্থ করতে যেতে হলে মূলত তিনটি শর্ত থাকে। ৪১ দিন নিরামিষ খাওয়া; মদ, সিগারেট ও নেশাভাং না করা; ৪১ দিন যৌন সংসর্গ না করা। ৪১ কেন? আয়াপ্পার নাকি মহিষীকে শেষ করে, বাঘের পিঠে চড়ে রাজ্যে ফিরতে ৪১ দিন লেগেছিল।

এই সব নিয়ে হাসাহাসির আগে নারীবাদীদের কয়েকটি জিনিস জেনে রাখা ভাল। হিমালয়ের পঞ্চকেদারের মতো কেরলে পাঁচটি আয়াপ্পা মন্দির। পাঁচটিই জঙ্গলে, কোনও-না-কোনও নদীর ধারে। শবরীমালার মতো ব্রহ্মচর্য ও নিরামিষ ভক্ষণ অন্য কোথাও পালন করতে হয় না। আচানকোভিলের জঙ্গলে আয়াপ্পা গৃহস্থবেশে, পূর্ণা ও পুষ্কলা নামে দুই স্ত্রীর সঙ্গে। ভক্তিমতী পুষ্কলা সৌরাষ্ট্র থেকে-আসা এক বণিকের কন্যা, রেশমসম্ভার নিয়ে মাদুরাই যাচ্ছিলেন। পথে দেবতার স্ত্রী বনে যান!

আচানকোভিলও ঘোর অরণ্যে। দুপুরে মন্দিরের পিছনে এক দোকানে গোমাংস আর ভাত খাওয়া গেল। স্থানীয় মুসলমান যুবকের দোকান। লজ্‌ঝড়ে টেবিলে বসে খাচ্ছি, চোখ আটকে গেল সামনের দেওয়ালে। হরপার্বতীর ছবি। ভারতবর্ষ হিন্দুত্ববাদী বা সেকুলার, দুই তরফের কারও বয়ানে থাকে না, বরং ধরা দেয় মিথ আর উপকথায়।

ইতিহাসবিদরা বলেন, শবরীমালা ও কেরলের আয়াপ্পা-মিথ যে পান্ড্যলাম রাজবংশকে নিয়ে, তাঁরা আসলে মাদুরাইয়ের পান্ড্য রাজবংশের শাখা। মাদুরাই বরাবর নাম-করা বাণিজ্যকেন্দ্র, মেগাস্থেনিসের লেখাতেও এ শহরের উল্লেখ আছে। এই শহরেই মীনাক্ষী মন্দির। মীনাক্ষী আর সুন্দরেশ্বর শিবের বিয়েতে সেখানে কন্যা সম্প্রদান করেন বিষ্ণু। শৈব-বৈষ্ণব সম্মিলন আয়াপ্পার জন্মেও!

এই মিলনও পরের কথা। শবরীমালা ও তার আশপাশের পাহাড়ে মালা আরিয়া নামে এক জনজাতির বাস। তাঁরা বলেন, আয়াপ্পা আসলে তাঁদের দেবতা। পরে বর্ণহিন্দুরা আত্মসাৎ করেছে।

হতে পারে। জঙ্গলে আয়াপ্পার মন্দির দেখলে বোঝা যায়, এগুলি আসলে আমাদের শীতলা, পাঁচু ঠাকুরের মতো গ্রামদেবতার থান। নদীর ধারে সীমানা বজায় রাখে। শবরীমালায় যাওয়ার আগে ভক্তেরা ইরুমেলিতে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে যে ভাবে নাচেন, বোঝাই যায়, এটি এক ধরনের রণবাদ্য। ভক্তেরা অনেকে কাঠের ছোট ছোট খেলনা তির, বর্শা কিনে শবরীমালার রাস্তায় শরমকোঠি নামে একটি জায়গায় রেখে আসেন। এখানেই গ্রামদেবতার বৈশিষ্ট্য।

গ্রামদেবতা অবশ্য নিজের রূপ বদলে অন্য ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই আছে শীতলাঘাট। উনিশ শতকে কাশীতে তখন খুব বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব। শীতলাও আর গ্রামদেবতা নন, মহামারির দেবী। তাঁর নামেই বাংলার বাইরে হল ওই ঘাট।

আয়াপ্পাও সেই ভাবে কেরলের আচানকোভিল, আরিয়ানকাভুর জঙ্গলে প্রায় গ্রামদেবতা হিসেবে অধিষ্ঠিত। নেই খাদ্যাখাদ্য, ব্রহ্মচর্য, শুচি-অশুচির বিধিনিষেধ। কিন্তু শবরীমালার নিয়ম অন্য। বোঝা যায়, এটি বৈষ্ণব প্রভাব। শিবমন্দিরে এই কড়াকড়ি নেই। কেদার, বিশ্বনাথ বা বৈদ্যনাথধামে আপনি গাঁজায় সুখটান দিয়ে, স্নান না করে, ভরপেট খেয়েও মন্দিরে যেতে পারেন।

কিন্তু গ্রামদেবতারও সংস্কৃতায়ন ঘটে। নতুন শবরীমালার রূপরেখা সেখানেই। সংস্কৃতায়নে তার লাভ বই ক্ষতি হয়নি। আগে যেখানে নভেম্বর-ডিসেম্বরের উৎসবে কয়েক হাজার লোক যেতেন, এখন ৫৫ লক্ষের উপরে। হিসাব বলছে, ২০০৪ সালে ওই দু’মাসে মন্দিরের আয় ছিল মেরেকেটে ৬২ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে সেটি বেড়ে ২১৮ কোটি টাকা। এর পর মেয়েদের প্রবেশ, সমানাধিকার নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবে কেন শবরীমালা?

তাই ডিসেম্বরের মধ্যে তৃপ্তি দেশাই বা কোনও আন্দোলনকারী পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মন্দিরে ঢুকে যেতেই পারেন। কিন্তু সেটি শুধু রেকর্ড বইয়ের তথ্য হিসেবেই থেকে যাবে। জনজীবনে তার কোনও গুরুত্ব নেই।

পুনশ্চ: চার-পাঁচ দিন অক্লেশে শবরীমালার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কেউ আটকায়নি। বিজেপি সভাপতি তীর্থযাত্রীদের হেনস্থার সঙ্গে অযথাই গুলাগ দ্বীপপুঞ্জের তুলনা টেনেছিলেন! আসলে রাজনীতি এক, ধর্মীয় ঐতিহ্য আর এক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন