সম্পাদকীয় ১

ধর্মের কল

ধর্মের কল হয়তো বাতাসে নড়ে, তবে কল অবধি বাতাস পৌঁছাইতে নিদেনপক্ষে চৌত্রিশ বছর কাটিয়া যাইতে পারে। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লির শিখ-নিধনে অভিযুক্ত কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারের দণ্ডাজ্ঞা ঘোষিত হইল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

ধর্মের কল হয়তো বাতাসে নড়ে, তবে কল অবধি বাতাস পৌঁছাইতে নিদেনপক্ষে চৌত্রিশ বছর কাটিয়া যাইতে পারে। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লির শিখ-নিধনে অভিযুক্ত কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারের দণ্ডাজ্ঞা ঘোষিত হইল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে— ভারতবাসী এই কালক্ষেপে বিস্মিত হইবেন না, কারণ এই দেশের বিচার এমন বিলম্বিত লয়ে চলিয়াই থাকে। সত্য বলিতে কী, বড় রাজনৈতিক দলের বড় না হউক, মাঝারি মাপের নেতার দণ্ড যে শেষ অবধি হইয়াছে, ইহাতেই বরং বহু নাগরিক আশ্চর্য বোধ করিতে পারেন। একই ঘটনায় জড়িত রাঘব বোয়ালগণের মধ্যে যাঁহারা বহাল তবিয়তে রহিয়াছেন, কেহ কেহ হয়তো উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত আছেন বা অভিষিক্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের বিচার ও শাস্তি হইবে— এমন আশা, সজ্জন কুমারের দণ্ডাদেশের পরেও, অভিজ্ঞ নাগরিকরা দুরাশা বলিয়াই মনে করিবেন, তাহাতেও বিশেষ সন্দেহ নাই। কথিত আছে, বিলম্বিত বিচার অবিচারের শামিল। কথাটি সত্য। কিন্তু সেই সত্য মহান ভারতে বিলাসিতামাত্র।

Advertisement

ভারতে অপরাধ ও শাস্তির মধ্যবর্তী ব্যবধানটি কেন এমন বিপুল, সজ্জন কুমার মামলায় দিল্লি হাইকোর্টের রায় তাহা স্পষ্ট ভাবে বুঝাইয়া দিয়াছে। মহামান্য বিচারপতিরা যে কথাগুলি বলিয়াছেন, তাহার এই রূপ মর্মার্থ করিলে বোধ করি ভুল হইবে না: সংখ্যালঘু তথা দুর্বল মানুষদের চিহ্নিত করিয়া দুষ্কৃতীরা তাঁহাদের আক্রমণ করিয়াছে, তাহাদের প্রশ্রয় ও মদত দিয়াছেন রাজনীতিকরা, পুলিশ প্রশাসন তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করে নাই, করিলেও যথার্থ তদন্ত করে নাই এবং নিম্নতর আদালতও অভিযোগগুলিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দেয় নাই। অর্থাৎ, এই অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষই আপন কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ। অন্য ভাবে বলিলে, ইহা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যর্থতা নহে, গোটা ব্যবস্থাটিই অনাচারগ্রস্ত। বিচারালয়, বিশেষত হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলায় বারংবার এই ব্যাধি চিহ্নিত করিয়াছে, তাহার প্রতিকারে উদ্যোগী হইয়াছে, প্রশাসনকে অপরাধের যথাযথ তদন্তে বাধ্য করিয়াছে, নিম্নতর আদালতের বিচার নাকচ করিয়া নূতন করিয়া বিচারের আদেশ দিয়াছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা এবং সম্মান রক্ষায় উচ্চতর আদালতের ভূমিকা আজ বিশ্ববন্দিত। কিন্তু তাহার অন্য অর্থ ইহাই যে, ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য ভাল নহে, ভাল হইলে আদালতকে ক্রমাগত এমন পরিত্রাতার ভূমিকায় নামিতে হইত না।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি যাহাতে ঠিক ভাবে কাজ করে, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব শাসকদেরই। এবং ঠিক সেখানেই ভারতে, কী কেন্দ্রীয় স্তরে, কী রাজ্য স্তরে, প্রশাসনের চালকরা বহু ক্ষেত্রেই বিপরীত ভূমিকা পালন করিয়াছেন, করিয়া চলিয়াছেন। ক্ষমতাবানরা পুলিশ-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করিতে দেন না, কেহ নিরপেক্ষ কাজ করিতে চাহিলে তাহার পথে বাধা সৃষ্টি করেন। বস্তুত, অনেকাংশে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার ও প্রত্যক্ষ বাধার কারণেই আদালতের পক্ষেও সুষ্ঠু ভাবে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া চালনা করা দুঃসাধ্য হইয়া দাঁড়ায়। সোহরাবুদ্দিন শেখ প্রমুখের ‘ভুয়া’ সংঘর্ষে মৃত্যু সংক্রান্ত মামলায় সিবিআই আদালতের রায়ে অভিযুক্তরা সকলেই বেকসুর খালাস হইয়াছেন বটে, কিন্তু লক্ষণীয়, অভিযোগকারীদের সপক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলে নাই এবং সাক্ষীরা বিপরীতে চলিয়া গিয়াছেন। সাক্ষ্যপ্রমাণ না মেলা এবং সাক্ষীর উল্টা কথা বলা— এই দুই ব্যাধিই অতি পরিচিত। এবং, অনেক সময়েই, তাহার সহিত প্রশাসনিক অপদার্থতা ও অনাচারের সম্পর্ক অতি গভীর। দুষ্টের দমন প্রশাসনের কাজ। কিন্তু রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়, তবে শিষ্টের পালন অসাধ্য, অথবা অ-সম্ভব।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন