ভাষার সঙ্গে কুস্তি করে। ‘সুলতান’ ছবিতে সলমন খান।
সলমন খান যে কথাটা বলেছেন, তার সুর খেয়াল করলেই বোঝা যায়, তিনি ধর্ষিতার বেদনাকে অপমান করতে চাননি। ‘এক জন ধর্ষিতার যন্ত্রণা এমন কিছু একটা ব্যাপার নয়’— এটা বলা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি বলেছেন, শুটিং-এর শেষে তাঁর শরীরে এমন যন্ত্রণা হত, বোধহয় ধর্ষিতাদের এতটা ষন্ত্রণা হয় ধর্ষণের পর। যাঁরা রেগে গেছেন তাঁরা বলছেন, বাক্যটিতে ধর্ষণের বেদনার অমর্যাদা করা হয়েছে। ওই যন্ত্রণার মধ্যে যে অসীম অপমান, মনঃকষ্ট, সামাজিক কলঙ্ক এবং শারীরিক তছনছ মিশে আছে, সেটার কিছুটাও অনুধাবন করলে, কেউ এমন ফট করে ধর্ষণ কথাটা ব্যবহার করতে পারে না। ধর্ষণ শব্দটিকে কখনওই লঘু ভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু, তা হলে, কোনও শব্দই কি লঘু ভাবে ব্যবহার করা যাবে, যার সঙ্গে মানুষের অসহ্য যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে? যদি কেউ বলে, ‘উফ, ওর চাউনি আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিল’, তা হলে, সত্যিই বুকে ছুরি খাওয়া মানুষের তীব্র শারীরিক (মানসিকও, কারণ সে তুমুল ভয় পাচ্ছে, আর বাঁচবে না) যন্ত্রণাকে কি চূড়ান্ত অপমান করা হল না— কথাটা জাস্ট একটা মুগ্ধতার অনুষঙ্গে ব্যবহার করে ফেলে? ‘ক্রিস গেইল কী ব্যাট করছে রে, পাগলের মতো চার-ছয় মারছে!’, এই বাক্যে, মনোরোগীদের এলোপাথাড়ি ব্যবহারের মূলে যে অসুস্থতা, তার প্রতি অপমান নেই? যদি বলি ‘বাংলা শিল্প বামনে ছেয়ে গেছে’, তখন কি ভার্টিকালি চ্যালেঞ্জড মানুষদের অপমান করি না? যখন রবীন্দ্রনাথ প্রেম বোঝাতে লেখেন ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’, তখন কি তিনি, যারা সত্যিই জেনেশুনে বিষ পান করেছে, তাদের বিষটা খাওয়ার আগে যে তুলকালাম বিষাদ ও অভিমান; তাদের বিষ খাওয়ার সিদ্ধান্তে আসার পথে পেরোতে হয়েছে যে অবর্ণনীয় কষ্টের দিনরাত্রি; এবং বিষটা খাওয়ার অব্যবহিত পরে তাদের কণ্ঠনালী অন্ত্র ও পেটের যে দাউদাউ শরীর-তড়পানি— এই সব কিছুকে অপমান করলেন না? ঝগড়া করতে গিয়ে বউ যখন বলল, ‘এ সংসারে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে’, তখন সে কি, যাদের সত্যি সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসে লোহা-আঙুলের চাপে, বা দড়ির ফাঁসে, বা হার্ট অ্যাটাকে, তাদের অক্সিজেনের জন্য আকুল তনছট বায়োলজিকাল কষ্টটা আন্দাজ করে, মনে মনে সেই কষ্টের সঙ্গে নিজের মানসিক কষ্টটাকে ওজন করে, তার পর কথাটা বলেছে?
না কি, অন্য সব দুর্দশার কথা যে ভাবে খুশি ব্যবহার করা গেলেও, ধর্ষণের কথাটা যাবে না? কারণ ধর্ষণের বেদনা সব বেদনার বেশি। তীব্রতম। কেউ এই ‘বেদনা-কৌলীন্য’কে অস্বীকার করে বলতে পারে, ধর্ষিতা তবু তো জীবনে ফিরে আসতে পারেন, এক দিন হয়তো আনন্দেও নিমজ্জিত হতে পারেন, কিন্তু খুন হওয়া লোক তো আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না, তার তো সব শেষ হয়ে গেল নিশ্চিত ও নিঃশর্ত ভাবেই। তা হলে ‘খুন’ শব্দটা লঘু ভাবে ব্যবহার হলে, তা-ই সবচেয়ে অপরাধ। ‘আমায় গুণ করেছে খুন করেছে ও বাঁশি’ যেন কখনও লেখা না হয়। এ ভাবে ফতোয়া দেওয়া এক বার শুরু হলে, ঢল নেমে যাবে। সন্তানহারা মা বলবেন, ‘অমন মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন, পুত্রশোক?’ এর চেয়ে হীন বাক্য সলমন বলেননি। আর যে লোকটা খ্যা-খ্যা হেসে বলল, ‘অ্যা বাবা, কী হাড়সার চেহারা, এ তো সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট!’, তাকে তিরস্কার করে এনজিও-কর্মী বলবেন, যে দেশে অবিশ্বাস্য দুর্ভিক্ষে বছরের পর বছর লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন, সে দেশের অনাহার ও অপুষ্টিজনিত শীর্ণতাকে ব্যঙ্গের উপাদান করার চেয়ে নিষ্ঠুর আর কিচ্ছু হতে পারে না, কিচ্ছু না!
কেউ বলতে পারেন, না না, এ সব কথাই বলা যাবে, কিন্তু আইকন হলে যাবে না, ক্যামেরার সামনে যাবে না। সে উদ্ভট পরোয়ানা হল, কারণ পলিটিকাল কারেক্টনেস তো টিভিসাপেক্ষ হতে পারে না। ধর্ষণ নিয়ে কথা বলতে গেলে যদি অতিসচেতন হতে হয়, তা হলে শুধু সলমনকে নয়, হরিদাস পালকেও হতে হবে। সাধারণত কথায় কথায় ধর্ষণ শব্দটা ব্যবহার করা হয় ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিগৃহীত হচ্ছি’ বোঝাতে। অনায়াসেই অনেকে লেখেন-বলেন, এস্ট্যাবলিশমেন্ট বাংলা সাহিত্যকে ধর্ষণ করছে। পুঁজিবাদ সাধারণ মানুষকে ধর্ষণ করছে। বা, আর বলিস না, অফিস আমাকে প্রতি মাসে ধর্ষণ করছে। অর্জুন যখন গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে বলেন, ‘আমরা বেদজ্ঞ ও শত্রুদমনে সমর্থ, তথাপি রাত্রিকালে আমাদের ধর্ষণ করলে কেন?’, তখন ‘পীড়ন’ অর্থে বলেন। যদি কড়া নিয়ম করে দেওয়া হয়, ধর্ষণ শব্দটা এ বার থেকে একটাই অর্থে ব্যবহার হবে, আর তা করতে পারবেন শুধু ধর্ষিতারা, (কারণ অ-ধর্ষিতা নারীও তো ওই বেদনার সম্যক অনুভবে অপারগ), ধর্ষকরা (স্বীকারোক্তির সময়, ‘হ্যাঁ, ধর্ষণ করেছি’), আর অবশ্যই আদালত, কিন্তু আর কেউ না— তা হলে শব্দটার দ্যোতনা তো কমে যাবে বটেই, সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যাবে বাংলায় ক্ষোভ প্রকাশ করার মোক্ষম শব্দবন্ধ।
কোনও সন্দেহই নেই, কাউকে আঘাত না করা খুবই ভাল। কোনও কথায় যদি কারও যন্ত্রণাকে ছোট করা হয়, সে কথাটা না বলাই ভাল। কিন্তু তা হলে এই পৃথিবীতে কথা বলা যাবে কি? সমস্ত স্বতঃস্ফূর্তির মুখে পাথর চাপা দিয়ে (সরি, যাঁদের মুখে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছে তাঁদের যন্ত্রণাকে ছোট করেই বলছি) একটা পলিটিকালি কারেক্ট পৃথিবী তৈরি করে তাতে একটা গাছ-আড়ষ্ট যাপন, হেডস্যরের ভয়ে জুলজুল সিঁটকাউয়া বাঁচা কি চমৎকার হবে? অনেকে বলবেন, সেটা এখন খুব অ্যাবসার্ড মনে হলেও, আস্তে আস্তে শিখে নিতে হবে, এবং এক বার আয়ত্ত হয়ে গেলে ওটাই স্বতঃস্ফূর্তির স্রোতটা পেয়ে যাবে আর ওর মধ্যে দিয়েই দিব্যি আনন্দ ঝলকাবে। কিন্তু তা বোধহয় একটা তাত্ত্বিক সম্ভাবনা বই আর কিছুই নয়। মানুষের ভাষা বাধ্যতামূলক ভাবে শুধু ঔচিত্যকে ভজনা করতে শুরু করলে, পৃথিবী থেকে প্রায় সব আনন্দই উবে যাবে। পর্নোগ্রাফি, চুটকি ও গালাগালি তো উধাও হবেই (কারণ এদের মূল রসটাই উৎসারিত হয় অসমীচীনতা থেকে), বিশ্বসাহিত্যের অনেকটাই বাতিল হয়ে যাবে। রূপকথা তো একেবারে প্রথমেই ডাস্টবিনে, কারণ তার মধ্যে অন্যায়ের ছড়াছড়ি (প্ররোচনাহীন ভাবেই নেকড়ে এসে ঠাকুমা ও নাতনিকে খেতে চাইছে, রাজপুত্র শুধু নিজের লাভের জন্য রাক্ষসের প্রাণভোমরা টিপে মারছেন, রূপবান ও রূপবতীকেই কাঙ্ক্ষণীয় ভাবা হচ্ছে, হেঁটে কাঁটা ওপরে কাঁটা দিয়ে সুয়োরানিকে রাজা মেরে ফেলছেন)। ক্যান্টিন ও বৈঠকখানার আড্ডালীলার তো দফা গয়া, এমনকী কাগজে এ হেডলাইনও লেখা যাবে না: ‘বরানগরে মশার উপদ্রব বাড়ল’। কারণ মশা তো ‘উপদ্রব’ করেনি, সে তার স্বাভাবিক খাদ্য আহরণের চেষ্টা করেছে মাত্র। তাই প্রকৃত সতর্ক ও যথাযথ হেডলাইন হওয়া উচিত: ‘বরানগরে মশার সংখ্যা বেড়ে গেছে, এবং তারা খাবার পাওয়ার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই মানুষকে কামড়াচ্ছে, এবং যদিও তাদের সংখ্যা বাড়ার পিছনে তাদের সচেতন চক্রান্ত নেই এবং মানুষের কী ক্ষতি তারা করছে তাও বোঝার ক্ষমতা নেই, এবং মানুষ এই সভ্যতা স্থাপন করেছে বলে মানুষই সব ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাবে ও অন্য প্রাণীর অধিকার সম্পর্কে নির্লিপ্ত বা অবজ্ঞাময় থাকবে— তাও এক অন্যায়, বরঞ্চ ক্ষমতা যত বাড়ে ততই অন্যের অধিকার বিষয়ে সচেতন হওয়ার দায়িত্বও বাড়ে, এবং কামড়ের বিরক্তি সহ্য করতে না পেরে মশার প্রাণ হরণ করলে তা সামান্য কষ্টের বাড়াবাড়ি প্রতিক্রিয়া বলেই প্রতিভাত হতে পারে, তবু, মানুষের সভ্যতায় অমন সামগ্রিক ঠিকতা বজায় রাখতে গেলে এক সময় বাঁচা দায় হয়ে পড়বে বলে লিখি, বরানগরে মশার উপদ্রব বেড়েছে।’ কোনও কাগজই ৩৯৮২৮ পাতার কম হবে না, মালিক ভয় পেয়ে কাগজ বন্ধ করে দেবে। অবশ্য দেউলিয়া হওয়ার ভয়ে সংবাদ পরিবেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত পলিটিকালি কারেক্ট কি না, জানি না।
না, বলছি না, চলুন সব সময় পলিটিকালি ইনকারেক্ট কথা বলি ও আনন্দে নেত্য করি। চলুন দলিতদের অপমান করে চুটকি তৈরি করি, আর কেউ প্রতিবাদ করলে বলি, মস্তি চটকে দিল, বেরসিক! বলছি, কেউ কোনও কথা বললে, ইনটেনশনটা আগে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। সলমন কথাটা বোকার মতো বলে ফেলেছেন ঠিকই, কিন্তু এতটা হইহই করার আগে ভাবতে হবে, কোথাও কি তিনি সত্যি ধর্ষিতাদের ব্যথাকে ছোট করে দেখাতে চেয়েছিলেন? উদ্দেশ্যটা বা লক্ষ্যটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে, আক্ষরিক ষত্ব-ণত্ব ধরে অতটা টানাটানি করলে ঠিক হবে না। ধর্ষণকে লঘু ভাবে দেখা যেমন অশালীন, যেখানে-সেখানে গুরু কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টাও তেমনই উদ্ভট। একটু পায়ে পা দিয়ে সেমিনার বাধানোর মতো মনে হয়। স্পর্শকাতরতার চাকরি নিলাম, আর একটা কথা কে কোথায় বলল অমনি খুঁটে খুঁটে অপমান বের করতে বসে গেলাম— ওই রে ওই ফিল্মটায় ওই জাতকে, প্রবন্ধটায় অমুক ধর্মকে, পদ্যটায় তমুক ঈশ্বরকে ঠেস দিল— পলিটিকাল কারেক্টনেসের ফ্যাশনে গা ভাসিয়ে এ ওভার-রিঅ্যাক্ট করাকরি এখন বড্ড বেড়েছে। প্রতিবাদ ও সচেতনতা দারুণ জিনিস, কিন্তু অতি উৎসাহের চোটে ‘জিভ কাটো লজ্জায়’-এর ট্রেন এমন হুড়মুড় ছাড়লে, অবিলম্বে ‘মুখ ঢেকে যায় কারেকশনে’-র স্টেশনে ঢুকে পড়বে।
এই ঘোটালায় অ-পণ্ডিতদের একটা উপায় আছে, কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া। বোবার শত্রু নেই, ব্লগ-বাইলাইনের ঝাড়ও নেই। সলমন এ জন্যেই বলেছেন, এ বার থেকে কম বলব। আর এক হয়, সেলোটেপ দিয়ে মুখ এঁটে রাখা। কিন্তু নারীবাদীরা সব্বাই পহলাজ নিহলানির মতো দেখতে হয়ে গেলে, হাসির তোড়ে সেই সেলোটেপ ছিঁড়ে না যায়!