প্রস্তুতিপর্ব

গভীর দুর্ভাগ্যের বিষয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্বে পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতি বিশেষ ভাবে হিংসা-ধ্বস্ত হইতে চলিয়াছে, রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাত্রা অনেক গুণ বাড়িতে চলিয়াছে, এমন একটি আলোচনা এখন দেশের প্রতি কোণে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

নিহত তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস।

তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস খুনের ঘটনাটি, পশ্চিমবঙ্গেও চমকপ্রদ। নিজের পাড়ায় সরস্বতী পূজা চলাকালীন সরাসরি বিধায়কের কপালে বন্দুক ঠেকাইয়া খুন করিবার ঘটনার মধ্যে এমন কিছু আছে যাহা এই রাজ্যের সাম্প্রতিক কালের হিংসাদীর্ণ রাজনীতির মধ্যেও কল্পনা করা সহজ নয়। অথবা বলা চলে, কল্পনা ছাড়াইয়া বাস্তব যে কোথায় গিয়া ঠেকিয়াছে, তাহার সম্যক উপলব্ধিটি রীতিমতো কঠিন। মানিতেই হইবে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এই কালে এমন ঘটনা সুলভ নহে। কোনও সন্দেহ নাই, ভারতের রাজনীতি অধিকাংশ রাজ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময়। তবু হাঁসখালির সংবাদটির সহিত পাল্লা দিবার তুল্য ঘটনা অন্য প্রদেশগুলি আজ আর দেখাইতে পারিবে বলিয়া মনে হয় না। যে সব রাজ্যে একদা হিংসা একটি ভয়ানক দৈনন্দিন চর্চায় পৌঁছাইয়া গিয়াছিল, সে সব জায়গায় কেন এখন প্রকাশ্যে বিধায়কদের গুলি করিয়া মারা হইতেছে না, আর কেনই-বা পশ্চিমবঙ্গ এই অসামান্য অর্জনে সমৃদ্ধ হইতেছে, তাহা সুগভীর চর্চার বিষয়। আপাতত সেই চর্চায় না গিয়া বলা চলে, এই বারের ঘটনায় চমক কেবল পশ্চিমবঙ্গের পরিধিতে আবদ্ধ নাই, জাতীয় স্তরে ইহা রাজ্য রাজনীতির বিজ্ঞাপন হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

Advertisement

গভীর দুর্ভাগ্যের বিষয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্বে পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতি বিশেষ ভাবে হিংসা-ধ্বস্ত হইতে চলিয়াছে, রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাত্রা অনেক গুণ বাড়িতে চলিয়াছে, এমন একটি আলোচনা এখন দেশের প্রতি কোণে। বোঝা সহজ— বিজেপির এই বারের নির্বাচনী হিসাবখাতায় পশ্চিমবঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করিতেছে বলিয়াই এই আলোচনার প্রস্ফুরণ। অস্যার্থ, রাজ্যে শাসক বনাম বিরোধী সংঘর্ষের তীব্রতা ধাপে ধাপে বাড়িতে চলিয়াছে। শাসক দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী-সংঘর্ষও আরও তীব্র হইতে চলিয়াছে। হাঁসখালির ঘটনার প্রকৃত উৎস ও কার্যকারণসূত্র তদন্তসাপেক্ষ, তাহা লইয়া জল্পনা অনুচিত। কিন্তু প্রাক-নির্বাচনী রাজনীতির হিংসাত্মক দুর্লক্ষণ অতি প্রকট। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনকালীন অভিজ্ঞতা যদি কোনও প্রদর্শক হয়, তবে আশঙ্কার বিলক্ষণ কারণ আছে যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে আগামী কয়েকটি মাস ভয়ঙ্কর দাঁড়াইবে।

রাজ্য রাজনীতির এই পরিস্থিতিতে রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকাটি দৃঢ় হইবার কথা ছিল। শাসক-বিরোধী সংঘর্ষ কিংবা শাসক দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাত অথবা অন্যবিধ দ্বন্দ্ব— কারণ যাহাই হউক না কেন, তাহা যদি প্রকাশ্য সন্ধ্যায় জনপরিকীর্ণ স্থানে বিধায়ককে হত্যা করিবার মতো ভয়ানক পর্যায়ে উঠিয়া যায়, সেই ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রশাসকদের সক্রিয়তা অনেকখানি বাড়িবার কথা ছিল। অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিতকরণ ও শাস্তিদানের উদ্যোগ অতীব জরুরি কাজ হইবে, এই প্রত্যাশা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক আজ আর স্বাভাবিক নয়। যে দুষ্কৃতীরা এমন কাজ করিতে পারে, তাহারা ঠিক রাজনীতিক গোত্রীয় নয়, মাফিয়া-গোত্রীয়, সুতরাং তাহাদের সহিত রাজনীতিকদের দূরত্ব বাড়ানো প্রয়োজন— এমন বিবেচনা আজ হয়তো আশাতীত। নিরাশ নাগরিককে দোষ দেওয়া যায় না। তবে কিনা, পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের দায়দায়িত্ববোধ বিষয়েও বেশি বাক্যব্যয় না করাই ভাল। সাহিত্যসংস্কৃতি-অঙ্গনে শান্তিপ্রিয়তার জন্য নিয়মিত ভাবে গৌরবান্বিত হয় যে বাঙালি জাতি— তাহার ইতিহাস এবং তাহার বর্তমান কিন্তু অন্য কথাই বলে। হিংসার প্রতি তাহার দুর্দমনীয় আকর্ষণের দিকে ইঙ্গিত করে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হিংসার রাজনীতিকে ভয় পাইবে, না কি রাজনীতির রক্তাক্ত খেলার প্রতি আরও বেশি করিয়া আকর্ষণ বোধ করিবে, সেই আন্দাজ সহজ নয়। সুতরাং হতাশ, বীতশ্রদ্ধ নাগরিক বলিতেই পারেন— হাঁসখালির পথ-অনুসারে ‘ধ্বংসের মুখোমুখি’ হইবার প্রস্তুতি চলুক।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন