প্রবন্ধ ১

‘একবারই মারাত্মক বকেছিলেন মানিকদা’

সত্যজিৎ রায় তাঁর সাতাশটি ছবির চৌদ্দোটিতে প্রধান ভূমিকায় নিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। পরিচালক সত্যজিৎ শিখিয়েছেন অনেক, কিন্তু নায়কের জীবন-জীবিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষটির ভিতরে এক পিতৃপ্রতিম ব্যক্তিত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন সৌমিত্র।বকেছিলেন এক বারই, মারাত্মক বকেছিলেন। অভিযান-এর শুটিং-এর সময়। তার আগে যে আমায় দু’এক বার বকেননি তা নয়, তবে সেটা অভিযান-এর সময়ে যে ভাবে বকেছিলেন তার মতো নয়। আর সেখান থেকে ওঁর মানুষ পরিচয়টা আমার কাছে খুব বড় হয়ে ওঠে।’ বলতে বলতে ঈষৎ আবেগে গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে ওঠে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। গল্ফ গ্রিন-এ তাঁর বাড়িতে বসে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে শুনছিলাম তাঁর কাছ থেকে, শেষ বিকেলের আলো আসছিল।

Advertisement

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share:

টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে অপুর সংসার-এর শুটিংয়ে (বাঁ দিক থেকে) সৌমেন্দু রায়, সুব্রত মিত্র, সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র। ছবিটি বংশী চন্দ্রগুপ্তের তোলা।

বকেছিলেন এক বারই, মারাত্মক বকেছিলেন। অভিযান-এর শুটিং-এর সময়। তার আগে যে আমায় দু’এক বার বকেননি তা নয়, তবে সেটা অভিযান-এর সময়ে যে ভাবে বকেছিলেন তার মতো নয়। আর সেখান থেকে ওঁর মানুষ পরিচয়টা আমার কাছে খুব বড় হয়ে ওঠে।’ বলতে বলতে ঈষৎ আবেগে গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে ওঠে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। গল্ফ গ্রিন-এ তাঁর বাড়িতে বসে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে শুনছিলাম তাঁর কাছ থেকে, শেষ বিকেলের আলো আসছিল।

Advertisement

‘অভিযান-এর আগে যে দু-এক বার বকেছেন তা খানিকটা আমাকে পথে আনার জন্যে, ছোট ছিলাম তো, তখন কতই-বা বয়স, তেইশ, যখন ওঁর সঙ্গে কাজ করতে এসেছি।’ অপুর সংসার-এর কথায় ফিরে যান সৌমিত্র। অপর্ণার মৃত্যুর পর সব কিছু ছেড়েছুড়ে অপু চলে গিয়েছিল কোলিয়ারিতে, চাকরি করছিল সেখানে। সে দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের চিরিমিরি-তে। ‘বনজঙ্গল পাহাড়-ঘেরা কয়লাখনির অমন নিসর্গ শোভা কমই দেখেছি। শীতের মুখে আমরা সেখানে শুটিং করতে গেলাম। ঝরনার জল খাওয়ার একটা শট ছিল, সেই সময়টা আমি বোধহয় একটু বেশিই হইহই করছিলাম, ইউনিটের অন্যদের সঙ্গে ভাব জমে গেলে যা হয় আর কী! মানিকদা খুব ধমক দিয়ে আমাকে ডাকলেন, তার পর সেই জলদ্‌গম্ভীর গলা: ‘মন দিয়ে করো কাজটা।’ পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আমাকে তৈরি করার জন্যই ও ভাবে বকেছিলেন।’

১৯৫৮-র অগস্টে অপুর সংসার-এর শুটিং শুরু করেছিলেন সৌমিত্র। তার পর দেবী। প্রায় এক বয়সি অনেকেই তখন তাঁর বন্ধু হয়ে গিয়েছেন, সৌমেন্দু রায় থেকে নিত্যানন্দ দত্ত, নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ার্কি-ফাজলামিতে তরতর করে দিন কেটে যেত শুটিংয়ের। সে সবে আপত্তি করতেন না সত্যজিৎ। তবে মাঝেমধ্যে একটু রাশ টানাও দরকার বলে মনে হত তাঁর। মুর্শিদাবাদে গঙ্গার ধারে শুটিং করছেন দেবী-র, শট নেওয়ার আগে সৌমিত্রকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার ডায়লগ-শিট কোথায়?’ আমতা-আমতা করেন সৌমিত্র: ‘আনিনি তো।’ তৎক্ষণাৎ নির্দেশ সত্যজিতের, ‘যাও গিয়ে নিয়ে এসো।’ দৌড়লেন সৌমিত্র, প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিমতিতা-র রাজবাড়িতে ক্যাম্প হয়েছে ইউনিটের, সেখান থেকে সংলাপের কাগজটি হাতে নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরলেন, তার পর শুটিং শুরু হল তাঁর।

Advertisement

‘ডায়লগ-শিট হাতে রাখা যে খুব একটা পছন্দ করতেন মানিকদা, তা নয়, তবে সঙ্গে রাখতে বলতেন, কখন দরকার লাগে। আমি তো নিয়ে যাইনি, অতএব... আর জীবনে কোনও দিন এ ভুলটা হয়নি। আসলে এটাই শেখাতে চেয়েছিলেন— অভিনয়ের সময় যেন সর্বদা সিরিয়াস থাকি, সদা সতর্ক থাকি।’ তুখড় অভিনেতা যেন ছাত্রের মতো বলে চলেছেন তাঁর শিক্ষকের কথা। ‘এমন দু’এক বার ছাড়া আর কখনও বকেননি, কিন্তু প্রচণ্ড বকেছিলেন অভিযান-এর সময়।’

বীরভূমের দুবরাজপুরে অভিযান-এর শুটিং করতে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ, প্রথম বার প্রচণ্ড শীতে, শেষ বার প্রচণ্ড গরমে। রাত তিনটের সময় উঠে মেকআপ নিতে বসতেন সৌমিত্র, ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তে হত শুটিং-এ। ইউনিটের লোকজনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে যে কটা গাড়ি থাকত, সেগুলোর একটা চালাতেন সৌমিত্র নিজে, ড্রাইভারের ডিউটিটা তাঁর অভিনয়ের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল, চরিত্রটাই তো ড্রাইভারের। ‘অভিযান-এ নরসিং-এর জন্যে যতটা মেকআপ করতে হয়েছিল তা তখনও পর্যন্ত কোনও ছবিতেই আমি করিনি। গোড়াতেই মানিকদা ছবি এঁকে ঠিক করে ফেলেছিলেন নরসিং-এর প্রতিকৃতি কী হবে। মানিকদার সেই অগ্রিম পোর্ট্রেট থেকে এমন মেকআপ করেছিলেন অনন্ত দাস যে আমার চেহারা বদলে গিয়েছিল। তা ছাড়া ওই ক্রাইসলার গাড়িটাকে যথেচ্ছ চালিয়ে একেবারে আমার আজ্ঞাবহ করে তুলেছিলাম। আঁকাবাঁকা রাস্তায় এমন জোরে চালাতাম যে লোকজন সরে গিয়ে গালাগাল দিত— গায়ের ওপর গাড়ি তুলে দিচ্ছ, শালা পাঞ্জাবি। বুঝতে পারতাম মেকআপটা এতই জবরদস্ত যে কেউ আমায় চিনতেই পারছে না।’ সৌমিত্র এখন মনেই করেন ‘নরসিং-এর চরিত্রটা আমায় দিয়ে করানোয় ওই একটা ছবি করে আমার যতটা পরিণতি, আঙ্গিকের ওপর দখল— এমনকী চরিত্রের মধ্যে পৌরুষ ও ব্যক্তিত্ব সঞ্চার করার ক্ষমতা বেড়েছিল, তার আগে অবধি তা আমার অনায়ত্ত ছিল।’

তবু ‘মানিকদা’র কাছে বকুনি খেয়েছিলেন সৌমিত্র। কেন? ‘গাড়িটা ট্রেনটাকে ওভারটেক করেছিল ছবিতে, মনে আছে নিশ্চয়ই।’ খেই ধরিয়ে দেন তিনি: ‘একটা দৃশ্যে লেভেল ক্রসিং ধরে আড়াআড়ি পার হয়ে যাবে গাড়িটা, তার পর ট্রেনটা এসে বেরিয়ে যাবে, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা রাখা যায়নি। ট্রেনের সামনে ইঞ্জিনে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে মানিকদা। আমি তো এ দিকে তেড়েফুঁড়ে গাড়ি চালিয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে পৌঁছে গেছি। আনম্যানড্ ক্রসিং, যত এগোচ্ছি টের পাচ্ছি চাকা গাড্ডায় পড়ে যাচ্ছে। অগত্যা অ্যাকসিলারেটর-এ খুব জোরে চাপ দিলাম, গাড়িটা লাফিয়ে বেরিয়ে গেল, বেরোতে-বেরোতেই টের পেলাম নিমেষের মধ্যে পিছন দিয়ে ট্রেনটাও বেরিয়ে গেল। গন্তব্যে পৌঁছে সৌমেন্দুকে জিজ্ঞেস করলাম: ‘কী, শটটা ঠিক ছিল?’ ও-ই তো এ ছবির সিনেমাটোগ্রাফার, বার কয়েক শুধনোর পর ও শুধু বলল: ‘যাও-না, তোমার হবে!’ আমি তো কিছু বুঝতে পারলাম না, দেখলাম দূরে গাছতলায় মানিকদা বসে আছেন। সেখানে গিয়ে শুধু বলেছি ‘মানিকদা, শটটা ঠিক ছিল?’ অমনি রাগে ফেটে পড়লেন: ‘তুমি স্টান্টম্যান? স্টান্ট দেখাতে এসেছ, না অভিনয় করতে এসেছ? কে তোমাকে ও রকম রিস্ক নিয়ে গাড়ি চালাতে বলেছিল? সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত, আমার তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিল...’ রাগে গন্‌গন্‌ করছিল মানিকদার মুখ।’

এক টানে কথাগুলো বলার পর গলায় যেন একটু বাষ্প জমে ওঠে সৌমিত্রর: ‘সে দিনটার কথা আজীবন মনে থাকবে, কোনও দিন ভুলতে পারব না। আমাকে নিয়ে কী মৃত্যুভয় মানিকদার, কী কন্‌সার্নড আমার সম্পর্কে!’

সৌমিত্রর জীবন-জীবিকা নিয়েও এই রকম ‘কন্‌সার্নড’ থাকতেন সত্যজিৎ। প্রায় পিতার মতোই আগলাতে চাইতেন তাঁকে। তখন অপুর সংসার-এর শুটিং শুরু হবে, সৌমিত্র মনস্থির করে ফেলেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর চাকরিটা ছেড়ে দেবেন, আশঙ্কিত সত্যজিৎকে ‘আর কিছু না পারি, লেখাপড়া শিখেছি তো, ঠিক মাস্টারি জুটিয়ে নেব’ বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। ছবি হয়ে যাওয়ার পর সত্যজিৎ এক দিন গল্পচ্ছলে সৌমিত্রকে বললেন, ‘আমার এ ছবিতে তোমার কাজ যা হয়েছে তাতে লোকজন তোমায় কাজ দেবে। আর কিছু না হোক তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে তো কাজ করতেই পারো।’ ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে আশি পেরনো সৌমিত্রর আজ মনে হয় ‘আমাকে নিয়ে কী রকম যেন একটা দায় কাজ করত মানিকদার!’

‘বাবার এই দায়টা কাজ করত সৌমিত্রকাকুর ওপর নির্ভরতা থেকে।’ বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে সত্যজিৎ-সৌমিত্র সংক্রান্ত আসন্ন প্রদর্শনীর ছবি বাছতে বাছতে বলছিলেন সন্দীপ রায়। ‘সৌমিত্রকাকুর ছবি সব সময় বাবার কাছে থাকত, যখনই যে চরিত্রে তাঁকে ভাবতেন, মেকআপ-এর জন্য ওই ছবির ওপরই আঁকাআঁকি শুরু করে দিতেন। বিশেষ ধরনের মেকআপ-এর জন্য, যেমন অশনি সংকেত, সৌমিত্রকাকুকে নিজের সামনে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি আঁকতেন বাবা।’

১৯৯০-এ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের রেট্রোস্পেকটিভ হচ্ছিল, সত্যজিতের কাছে শুভেচ্ছাপত্র চাওয়া হলে তিনি লিখে পাঠান, ‘আমার তরফ থেকে সৌমিত্রকে সার্টিফিকেট দেবার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমার সাতাশটি ছবির চোদ্দটিতে সে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছে।... তার প্রতি আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পীজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে এটা আমি জানি।’

সত্যজিৎ রায় সোসাইটি-র সৌজন্যে প্রাপ্ত এই ছবিগুলি দেখা যাবে

আইসিসিআর-এ পয়লা মে থেকে সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড আই’-তে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন