যে দুটি কৃষ্ণগহ্বর মিলিত হয়ে নতুনটি তৈরি হল, ভারতের দৈর্ঘ-প্রস্থের তুলনায় সেগুলি এই রকমই।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের শতবর্ষ পরে আমরা প্রথম দেখা পেলাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের। ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক গ্যালাক্সিতে, দুই কৃষ্ণগহ্বরের যুগল নৃত্য চলছিল। এক জনের ভর আমাদের সূর্যের ২৬ গুণ, তার ব্যাস ১৫৬ কিলোমিটার। অন্য জন ভরে সূর্যের ৩৯ গুণ, তার ব্যাস ২৩৪ কিলোমিটার। এক সেকেন্ডের এক পঞ্চমাংশে সব শেষ। মহাকর্ষের টানে ওইটুকু সময়ের মধ্যে দুজনে মিলে একটি কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হল। তার ভর আমাদের সূর্যের ৬১ গুণ, তার ব্যাস ৪০০ কিলোমিটার।
দুই কৃষ্ণগহ্বর আলাদা থাকার সময় তাদের মোট ভর ছিল সূর্যের ৬৫ গুণ। জুড়ে যাওয়ার পর ভর দাঁড়াল সূর্যের ৬১ গুণ। বাকি ভরটা, অর্থাৎ সূর্যের চার গুণ, তার কী হল?
আইনস্টাইনের আর এক বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 বলে যে ভরকে শক্তিতে পরিণত করা যায়। এই কৃষ্ণগহ্বর সম্মেলনের ফল হল এই যে, এতে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হল, তার ঔজ্জ্বল্য আমাদের সূর্যের কোটি কোটি কোটি গুণ। আর এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে এই শক্তির বেশির ভাগ বিকিরিত হয়েছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের রূপে।
আমরা ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে বসে সাক্ষী হলাম এই দৃষ্টিকাড়া অতিজাগতিক আতসবাজির। মহাশূন্যে শব্দের বিস্তার ঘটে না, তাই আমরা এই মহাবজ্রের ঝংকার শুনতে পেলাম না। কিন্তু স্থান আর কালের মধ্য দিয়ে এর উচ্ছ্বাস পৌঁছল আমাদের কাছে।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, যার শতবর্ষ পালন করছি আমরা, তাতে বলা হচ্ছে যে কোনও দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণ হল, তাদের ভরের ফলে তারা তাদের আশেপাশের স্থান-কালকে বিকৃত করে। টানটান করে বাঁধা একটি চাদরের মাঝে একটা পাথর রাখলে যেমন তৈরি হয় এক উপত্যকা। সেখানে যদি একটা ছোট্ট গুলিকে গড়িয়ে দেওয়া হয়, তার উতরানকে আমরা ভাবতে পারি যেন বড় পাথরের আকর্ষণের ফল। আপেক্ষিকতাবাদ বলে, এই আকর্ষণকে আমরা যেন দেখি ওই অবতরণের ফল হিসেবে। তার মানে সর্বত্র স্থান-কাল আছে যেন এক চাদরের মতো। বস্তুর গতি অন্য বস্তুর আকর্ষণের ফলে নয়, এই স্থান-কাল-চাদরের উচ্চাবচতার ফলে।
তাই যদি হয়, তা হলে এই দুই তারকার সম্মেলনে যে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটল, তাতে উথালপাথাল হওয়া উচিত এই স্থান-কাল চাদরের। সুদূরপ্রসারী ঢেউ খেলে যাওয়া উচিত সব দিকে এই বিস্ফোরণের খবর নিয়ে, শব্দবিস্তার না হয় নাই হল। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বলবে, এমনটাই হওয়ার কথা। এই দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া স্থান-কালের অন্তরালে, আমাদের সীমিত দৃষ্টির বাইরে, মহাবিশ্বে সব সময় চলছে অনেক চমকপ্রদ ঘটনা। গ্যালাক্সি-গ্যালাক্সিতে মিশে এক হওয়া, তারায় তারায় ধাক্কা, ব্ল্যাক হোল আর নিউট্রন তারার সংঘাত। এ সব ঘটনায় আলো উত্পন্ন হয় না, তাই আমাদের চোখের গোচর কখনওই হবে না এই সব নাটকীয়তা। অথচ স্থান-কালের চাদর এতে আলোড়িত হচ্ছে। তাই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, মহাকর্ষ-তরঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে বিজ্ঞানের অনেক রহস্যের সমাধান।
মহাকর্ষ-তরঙ্গ সব বস্তুর মধ্যে দিয়েই সোজা পার হয়ে যায়, তাই এদের খোঁজ পাওয়া এবং শনাক্ত করা শক্ত। সেই সন্ধান চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই রাজ্য ওয়াশিংটন ও লুইজিয়ানায়। প্রকল্পটির নাম লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি। ২০০৬ থেকে ওয়াশিংটন-এর হ্যানফোর্ড আর লুইজিয়ানা-র লিভিংস্টনে দুই মানমন্দিরে চার কিলোমিটার লম্বা, ইংরিজির L আকারের ভূগর্ভস্থ নলে চলেছে এই তরঙ্গের খোঁজ। লেসার আলোর মাধ্যমে সরাসরি এই স্থান-কাল চাদরের উত্থানপতন মেপে পাওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে চলছে এই তরঙ্গের সন্ধান।
২০১৫-র সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছে অ্যাডভান্সড লাইগো— এই এক-ই যন্ত্রের দ্বিতীয় প্রজন্মের অনুসন্ধান। তার প্রথম সপ্তাহেই এই আবিষ্কার। কাল সন্ধেয় খবরটি প্রকাশিত হল। তাই আমাদের ধারণা, এ বার থেকে আমরা আরও অনেক মহাকর্ষ-তরঙ্গের খোঁজ পাব। এই আবিষ্কারে অনেক ভারতীয় বিজ্ঞানীর অবদান আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এমনই একটি যন্ত্র ভারতেও বসানো হচ্ছে। তার নাম লাইগো-ইন্ডিয়া। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় সর্ব স্তরের অনুমোদন হয়ে এসেছে।
পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এর নির্দেশক