অগস্টের ২ তারিখ থেকে আমরা সবাই ধারে বাঁচছি। আমরা মানে আমি, আপনি, মুকেশ অম্বানী, বিল গেটস, সব্বাই। পৃথিবীর কাছে ধার। ২ তারিখ ছিল ‘আর্থ ওভারশুট ডে’— ধারের খাতা খোলার দিন। বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীই আমাদের ভরসা। তার জল-হাওয়া, অরণ্যের গাছ, সমুদ্রের মাছ, জীববৈচিত্র, এ সবের ভরসাতেই মানুষ বাঁচে। আমাদের ছেড়ে দেওয়া কার্বন প্রকৃতি শুষে নেয়, ফিরিয়ে দেয় অক্সিজেন। আমরা যে সম্পদ ব্যবহার করি, প্রকৃতি তা ফের পূরণ করে দেয়। কিন্তু, একটা নির্দিষ্ট হারে।
ধারের হিসেবের সূত্রপাত এখান থেকেই। বছরের ৩৬৫ দিনে প্রকৃতি কতখানি সম্পদ পূরণ করতে পারে, তার হিসেব আমাদের জানা। আর, আমরা প্রতি দিন কতটা করে খরচ করে চলেছি, সে হিসেবটাও। প্রকৃতি গোটা বছরে যতখানি সম্পদ পূরণ করে, মানুষ তা যত দিনে শেষ করে ফেলে, তার পরের দিনটা থেকেই শুরু হয় ধারে বাঁচা। ২০১৭ সালের হিসেব যেমন বলছে, ২ অগস্টের মধ্যেই মানুষ এই বছরের কোটা ফুরিয়ে ফেলেছে। গত বছর ফুরিয়েছিল ৮ অগস্ট। আর ঠিক ৩০ বছর আগে, ১৯৮৭ সালে? সে বছর আর্থ ওভারশুট ডে ছিল ১৯ ডিসেম্বর।
ত্রিশ বছরে সাড়ে চার মাস এগিয়ে এল তারিখটা। অবশ্য, সেই শিল্পবিপ্লব থেকেই শুরু হয়েছে এই ভারসাম্যহীনতার দৌড়। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে শুরু হয়েছে একটা নতুন যুগ— অ্যানথ্রোপোসিন। নব্য মানব যুগ। মানুষের অর্থনৈতিক কাজকর্মের যে ছাপ পৃথিবীতে পড়ছে, প্রকৃতি আর তাকে মুছে ফেলতে পারছে না। এই শিল্পবিপ্লব থেকেই শুরু মানুষের ‘ভাল থাকা’। আরও বেশি করে পণ্য উৎপাদন করা, জীবনযাত্রার প্রয়োজনকে ক্রমে বাড়িয়ে তোলা, আর সেই প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত পণ্য ব্যবহার করতে পারা। যখন থেকে মানুষের সমৃদ্ধির শুরু, ঠিক তখন থেকেই পৃথিবীর ক্ষয়ে যাওয়ারও সূচনা।
অর্থনীতির দর্শনে হরেক প্রশ্নে বিভিন্ন মতের মধ্যে তুমুল বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু, ‘স্বাধীনতা’ মানে যে নিজের সাধ্যমত উপার্জন করতে পারার সামর্থ্য, এবং সেই উপার্জনকে জীবনযাত্রার মানের উন্নতির কাজে ব্যবহার করতে পারার ক্ষমতা, সে কথা সব মতই মানে। গত ত্রিশ বছর এই স্বাধীনতার চূড়ান্ত উদ্যাপন দেখেছে গোটা দুনিয়া। ভারতই কি কম পাল্টাল এই ত্রিশ বছরে? এয়ার কন্ডিশনার থেকে গাড়ি হয়ে বিদেশ সফর, যত ভাবে ভাল থাকা যায়, ভারতীয়রা কি থাকছেন না? ১৯৯২ সালের এপ্রিলে দেশে মোট ৬৫০৮খানা গাড়ি বিক্রি হয়েছিল। আর, ২০১৭’র মে মাসে বিক্রি হয়েছিল ২,৩২,০০১টা গাড়ি। অংকের হিসেবে, প্রায় ছত্রিশ গুণ ভাল থাকা। এই ভাল থাকার নামই তো স্বাধীনতা।
না কি, এক নতুন উপনিবেশবাদ? একাধিক? প্রথম উপনিবেশটা ভবিষ্যতের গর্ভে। প্রকৃতি যতখানি পুষিয়ে দিতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করা মানে আসলে প্রকৃতির থেকে নয়, ভবিষ্যতের থেকে ধার নেওয়া। আজ আমরা যা খরচ করে ফেলছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার অভাবে কষ্ট পাবে। উপনিবেশ থেকে সম্পদ তুলে নিয়ে আসতে যেমন সম্মতির প্রয়োজন ছিল না, ভবিষ্যতের সম্মতিও আমরা নিইনি। দ্বিতীয় উপনিবেশ অনুন্নত, এমনকী উন্নয়নশীল দুনিয়ায়। প্রকৃতির সম্পদ কে কতখানি ব্যবহার করছে, তার একটা পরিচিত সূচক হল কার্বন ফুটপ্রিন্ট— কার জীবনযাপনের দৌলতে কতখানি কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। সেই হিসেব বলছে, হাইতি বা সেনেগালের মতো দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু কার্বন ফুটপ্রিন্ট যথাক্রমে ৯৪ গুণ এবং ৪২ গুণ। ভারতের তুলনাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটপ্রিন্ট ১৭ গুণ বড়। সহজ হিসেব: যে দেশে সমৃদ্ধি যত বেশি, তার পায়ের মাপও তত বড়। প্রকৃতি অবশ্য মানচিত্রের তোয়াক্কা না করেই ধার উসুল করে নেবে। মার্কিন নাগরিকদের ভাল থাকার দাম চোকাতে হবে সেনেগালের গরিবকে। আর তৃতীয় উপনিবেশ? ঘরের পাশে, আরশিনগরে। সমৃদ্ধির সিঁড়িতে যাঁরা পা রাখতে পারেননি, বাজারে যাঁরা প্রবেশাধিকার পাননি, তাঁরাও প্রকৃতির দেনা চোকাচ্ছেন সমান ভাবে। বস্তুত অনেক বেশি মাত্রায়। প্রকৃতির রোষে সবচেয়ে বেশি নাকাল হয় গরিব মানুষই।
উপনিবেশ তৈরি, কারও মতামতের তোয়াক্কা না করেই তার সম্পদ নয়ছয় করে দেওয়া, তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া দেনার বোঝা— পরিবেশবাদীদের আপত্তি এখানে। কিন্তু, সব উপনিবেশে আপত্তি সমান নয়। খেয়াল করে দেখবেন, পরিবেশ সচেতনতার ভাষ্য তৈরি হয় প্রথমত এবং প্রধানত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি হতে থাকা সমস্যার আখ্যান দিয়েই। সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কার, গোটা দুনিয়ার, না কি আজ যাঁরা পৃথিবীর ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করে চলেছেন, তাঁদের, এই প্রশ্নের উত্তরও সেই ভাষ্যেই স্পষ্ট। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ‘পিপ্ল লাইক আস’-এর— বাজারের খেলায় যাঁরা জিতেছেন, যাঁরা আর্থিক ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করতে পেরেছেন, তাঁদের সন্তানসন্ততিরও যেন সেই ‘স্বাধীনতা’ বজায় থাকে, পৃথিবীটাকে ততটুকু ভাল রাখার চেষ্টা।
অনুন্নত দুনিয়ায় যে উপনিবেশ, তাকে নিয়ে উদ্বেগের পরিমাণ তুলনায় কম। তবুও, তার উল্লেখ আছে। দেশের সীমানার ভিতরে যে উপনিবেশ, নব্বই শতাংশ মানুষের ঘাড়ে পরিবেশের দেনা চাপিয়ে দিয়ে দশ শতাংশের ভাল থাকার সে অসাম্য নিয়ে পরিবেশবাদীদের দুনিয়ায় বিশেষ তর্ক নেই। দেশের মধ্যেও যে দেশ থাকে, উপনিবেশ থাকে— ভৌগোলিক গণ্ডি দিয়ে যে এই উপনিবেশগুলোকে ধরা যায় না, সে কথা পরিবেশ রাজনীতির ভাষ্যে ঠাঁই পায় না। সেই উপনিবেশগুলোকে চিনতে হলে মানুষকে চিনতে হয়। ঠিকানা দিয়ে নয়, শ্রেণি দিয়ে। শ্রেণির রাজনীতি দিয়ে। পরিবেশবাদীদের ভাষ্যের রাজনীতি শ্রেণি সচেতনতার নয়। হায় বামপন্থা, তোমার দিন গিয়াছে!
কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ে, আর্থ ওভারশুট ডে নিয়ে, কথা বলতে গেলে আসলে শ্রেণি রাজনীতির কথায় না এসে উপায় নেই। অর্থনৈতিক অসাম্যকে প্রশ্ন না করে উপায় নেই। অমর্ত্য সেন লিখেছিলেন, ভারতের একটা অংশ ক্যালিফোর্নিয়া, আর বাকিটা সাব-সাহারান আফ্রিকা। কেন্দুপাতা কুড়িয়ে যার দিন চলে, তার পদচিহ্ন কেন মুম্বইয়ের ছয় কামরার ফ্ল্যাটে থাকা কারও কার্বন ফুটপ্রিন্টের সমান হবে, তা নিয়ে আপত্তি না জানিয়ে উপায় নেই। অসাম্য কমলে, ভাল থাকা কিনতে পারার স্বাধীনতা আরও অনেক বেশি মানুষের নাগালে এলে তাতে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে, কার্বন ফুটপ্রিন্টের মাপ কমবে কি না, সেটা আলাদা তর্ক। কিন্তু, যদি না-ও কমে, অন্যের দেনার দায় বহন করার বাধ্যবাধকতাটুকু তো কমবে।
পরিবেশের প্রশ্ন যে আসলে শ্রেণির প্রশ্ন, এ কথাটা মেনে নিলে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নীতিতেও তার প্রতিফলন ঘটানোর দাবি তোলা যাবে। কাঠকুটো জোগাড় করে যাঁরা রান্নাঘরের আগুন জ্বালান, আর যাঁরা এসইউভি চেপে শাসন করেন শহরের রাস্তা— পরিবেশের ওপর এই দুটো কাজের প্রভাব যা-ই হোক না কেন, এই দুই গোত্রের মানুষের প্রতি সমদৃষ্টিতে তাকানো যে বিষম অন্যায়, এই কথাটা বলার জন্যও তো স্বীকার করতে হবে, অর্থনীতির খেলায় যাঁরা হেরেছেন, পরিবেশ নীতি যেন তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে।
সেটা বলার জন্য আগে এই উপনিবেশগুলোকে স্বীকার করে নিতে হয়। না হলে, ‘আর্থ ওভারশুট ডে’র মতো একটা কার্যকর ধারণাও শেষ অবধি ভাল থাকা মানুষদের আরও একটু ভাল থাকা নিশ্চিত করাতেই শেষ হয়ে যায়।