মিথ্যেতেই বিশ্বাস জন্মাচ্ছে

ফেসবুক এবং টুইটারের তুলনায় হোয়াটসঅ্যাপ-এর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। একটা রাজনৈতিক দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যখন কাউকে নেওয়া হয়, তিনি মনে করেন যে, ওই গ্রুপের, তথা সেই রাজনৈতিক দলের কাছে, তিনি এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সেখানে তাঁর কথার যথেষ্ট মূল্য আছে।

Advertisement

সুমন সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৯ ০০:৪১
Share:

নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। এই সময় একটা প্রশ্নের নিরসন হওয়া খুব দরকার— আগামী দিনে ভারতে আদৌ কোনও গণতন্ত্র কি থাকবে? না কি কেউ বা কারা শুধু কিছু কম্যান্ড দিয়ে ভারতের মানুষ এবং রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এবং সেটার জন্যই সারা দেশ জুড়ে স্মার্টফোনের জাল বিছানো হয়েছে?

Advertisement

খেয়াল করলে দেখা যাবে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মে মাস অবধি সারা দেশ, রাজ্য জুড়ে বেশ কিছু গুজব সচেতন ভাবে ছড়ানো হয়। রাজ্য-কেন্দ্র দুই প্রশাসনকেই সেই গুজব মোকাবিলায় রীতিমতো বেগ পেতে হয়। ছেলেধরারা নাকি চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা নাকি শরীর থেকে কিডনি বার করে নিচ্ছে। এই গুজবের ফলে দেশ জুড়ে প্রায় ৩৩ জন মানুষকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার ঘটনা সামনে আসে, এর মধ্যে ত্রিপুরাতে ৩ জনকে একসঙ্গে পিটিয়ে মারার ঘটনা রীতিমতো জাতীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় খবর হয়। কারণ সেখানে এমন এক জনকে পিটিয়ে মারা হয়, যাঁকে প্রশাসন থেকে পাঠানো হয়েছিল এই গুজবের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে। ঘটনাচক্রে এই সমস্ত গুজব ছড়ানোর মাধ্যম ছিল মূলত স্মার্টফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আখলাক, পহেলু খান-সহ যত জনকে গণপিটুনি দিয়ে মারা হয়েছে, তার বেশির ভাগের পিছনে এই গুজবের একটা বড় ভূমিকা ছিল। যাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তাঁদের অনেকের কাছেই হোয়াটসঅ্যাপ ইদানীং একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর পিছনে যে একটা গভীর রাজনৈতিক চক্রান্ত আছে, তা অনেকেই বুঝতে চাইছেন না বা বলা ভাল বুঝতে পারছেন না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে প্রায় ২০ কোটি মানুষ স্মার্টফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন এবং এঁদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনও গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত, তা সে পারিবারিক হোক বা অফিস হোক বা পাড়ার হোক, বন্ধুদের হোক বা রাজনৈতিক হোক বা অন্য কোনও গ্রুপ হোক। আর এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রোজ কোনও না কোনও ফরওয়ার্ড করা মেসেজ আসে। এগুলো কোথা থেকে আসে কেউ জানে না হয়তো। কিন্তু পাঠিয়ে দেয়। আসলে যে মানুষ যা বিশ্বাস করে, সে সেটাই পাঠায়। দেখা গিয়েছে, ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মোবাইলে আসা যে কোনও কিছুকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। যে মানুষ বিশ্বাস করেন সমস্ত মুসলমান সন্ত্রাসবাদী, তিনি ওই ধরনের কিছু পেলেই তাঁর পছন্দের কোনও গ্রুপ বা মানুষকে সেটি পাঠিয়ে দেন। যে মানুষ বিশ্বাস করতে চান সমস্ত মুসলমান অনুপ্রবেশকারী, তাঁরা কিন্তু এক বারও খতিয়ে দেখেন না যে তাঁর কাছে আসা মেসেজটির সত্যতা। আর এখানেই যাঁরা এই লেখা কিংবা ছবি বা ভিডিয়োগুলো বানিয়ে ছড়িয়ে দেন, তাঁরা জিতে যান। এই মুহূর্তে দেশের প্রতিটি মানুষ অত্যন্ত অনিশ্চিত ভাবে দিন কাটাচ্ছেন। নোট বাতিলের পর পর একটা মেসেজ ছড়ানো হয় যে, আসল ২০০০ টাকার নোটে নাকি ন্যানো চিপ লাগানো আছে। সুতরাং কেউ যদি সেটি লুকিয়ে রাখে তা হলেও সেটিকে ধরে ফেলা সম্ভব। কিংবা নতুন নোট স্ক্যান করলে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনা যায়। এগুলো মুখে-মুখে, বা বলা ভাল ফোনে-ফোনে ছড়ানো হয়েছিল। নোট বাতিল বা জিএসটি-র পরবর্তীতে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকের কাছেই এখনও স্মার্টফোন আছে। যে হেতু এ দেশের মানুষ খেতে পাক ছাই না পাক, তারা ফ্রি ডেটা বা ফ্রি ইন্টারনেট পরিষেবা পাচ্ছে কি না তা নিয়ে বেশি চিন্তিত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

Advertisement

ফেসবুক এবং টুইটারের তুলনায় হোয়াটসঅ্যাপ-এর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। একটা রাজনৈতিক দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যখন কাউকে নেওয়া হয়, তিনি মনে করেন যে, ওই গ্রুপের, তথা সেই রাজনৈতিক দলের কাছে, তিনি এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সেখানে তাঁর কথার যথেষ্ট মূল্য আছে। সেই জায়গা থেকেই তিনি এই গ্রুপগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে চান। তিনি মনে করেন যে এই তথ্য যখন তাঁর মোবাইলে এসেছে, তখন তাঁর একটা দায়িত্ব আছে, সেই তথ্য পড়া, বোঝা ও সেটা নিয়ে লোকজনের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করা। তাই তিনি তাঁর এই হোয়াটসঅ্যাপ-লব্ধ ধারণা নিয়ে রাস্তাঘাটে, অফিস কাছারিতে তর্কে নেমে পড়েন। তিনি মনে করেন, তাঁর কাছে যেটা এসেছে, সেটাই ধ্রুব সত্য, কিন্তু এক বারও প্রশ্ন করেন না, আচ্ছা এটা কি ঠিক?

এই নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগে অনেকেই হয়তো একটা মেসেজ পেয়েছেন “জেনে নিন এ বারের নির্বাচনের তারিখগুলি... অমুক দিন অমুক জায়গায়।’’ এই মেসেজটি যদি ভাল করে খেয়াল করা যায়, দেখা যাবে অজস্র বানান ভুলসমেত মেসেজটিকে পাঠানো হয়েছে। যিনি বা যাঁরা এই মেসেজটিকে প্রথম পাঠিয়েছেন, তাঁরা দেখতে চেয়েছেন কত জন মানুষ এই মিথ্যেতে বিশ্বাস করে, সেখান থেকেই তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা কত জনকে গ্রাস করে। এর পাশাপাশি প্রথম হওয়ার প্রবণতা থেকেও এটা আসে “দেখো সবার আগে আমি বলেছিলাম।’’ সবাই অর্থনীতিবিদ, সবাই শিক্ষাবিদ, সবাই রাজনৈতিক পরামর্শদাতা বা বিশ্লেষক।

হিটলারের জার্মানিতে প্রচারমন্ত্রী ছিলেন জোসেফ গোয়েবলস। তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি হল— মিথ্যে কথাও এত বড় করে বলা এবং এত বার বলা জরুরি যে মানুষ এক দিন ওটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। আজকের স্মার্টফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ অক্ষরে অক্ষরে সেই কাজটাই করে চলেছে। রাজনীতি মানুষের ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ছাড়া কিছু না। সরকারের দরকার একটি রাজনৈতিক দল অথবা এক জন নেতাকে, যার মধ্যে দিয়ে সে তার কাজকর্ম চালাতে পারবে। এই জন্যই মানুষের চিন্তাভাবনাকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সেই সময়ে তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে জার্মান রেডিয়ো দিয়ে। আর আজ হচ্ছে “মন কি বাত” এবং হোয়াটসঅ্যাপ বা হয়তো নমোঅ্যাপ দিয়ে। আজকের শাসক দলের এক প্রভাবশালী নেতার কথায় “নির্বাচন কোনও দিন অর্থনীতি দিয়ে জেতা যায় না, নির্বাচন জিততে হয় আবেগ দিয়ে।’’ সেই জন্যই কি বালাকোট নিয়ে এত প্রচার? সেই জন্যই কি মিশন শক্তি নিয়ে এত প্রচার? তবে আজকের সময়টা যে হেতু শাসক এবং বিরোধী— উভয় দলের জন্যই সমান সুযোগ নিয়ে এসেছে, তাই এখন বিরোধী প্রচারটাও হয়তো আসছে। কিন্তু খুব অসংগঠিত ভাবে। এতটাই যে, সেটা কোনও প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছে না।

তা হলে কি আশার কথা একটুও নেই? তা হলে কি এই সংগঠিত মিথ্যে প্রচারের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মাথা নত করবে? তা হলে কি এই নির্বাচনে হোয়াটসঅ্যাপে আসা ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচারই জয়ী হবে? এই নির্বাচনের পরে কি গণতন্ত্র বা সংবিধান-এর মতো শব্দগুলোকে ক্রমশ অভিধানে বা অন্য কোথাও খুঁজতে হবে? না, আশার কথা এটাই যে, এখনও ভারতের বেশির ভাগ মানুষের কাছে স্মার্টফোন, হোয়াটসঅ্যাপ বা নমোঅ্যাপ পৌঁছয়নি। এখনও পাড়ার রিকশা চালকের কাছে স্মার্টফোন পৌঁছয়নি, এখনও তিনি সারা দিন রিকশা চালিয়ে ১০০ টাকা রোজগার করে বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পান্তা খান। আর এটাই আমাদের ভারতবর্ষ, কোটি কোটি মানুষের ভারতবর্ষ।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন