প্রশাসন এবং আদালতের কাজটি কি সমাজ সংস্কারকের? আইনসম্মত উত্তরটি, না। প্রশাসন এবং আদালত দেখিবে যাহাতে দেশে বা রাজ্যে উন্নয়ন হয়, সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রজারা ন্যায় পায়। অন্য দিকে, সমাজকে শোধন করিবার এবং সেই সমাজে বসবাসকারীদের মধ্যে নীতিবোধ জাগ্রত করিবার ভারটি তাহাদের নহে, বরং উদ্দিষ্ট সমাজের কর্তাব্যক্তিদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কিন্তু যখন সমাজের মাথারা নিজ কর্তব্যে ব্যর্থ, তখন প্রশাসনকে ত্রাতার ভূমিকা লইতে হয় বইকি! ব্যারাকপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি ইহার দৃষ্টান্ত। সেখানে পুত্র-কন্যা-পরিত্যক্ত বৃদ্ধাকে এলাকাবাসীর উদ্যোগে ও পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যস্থতায় বাড়ি পাঠানো হইয়াছে। পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়া পুত্রকে জানাইতে হইয়াছে, সে মায়ের আজীবন দেখাশোনা করিবে।
এলাকাবাসী তো বটেই, পুলিশ এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের ভূমিকাটি এই ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবশ্যই। কিন্তু প্রশ্ন, কেন পুলিশকে চোর-ডাকাত ধরা এবং কাউন্সিলরকে এলাকার উন্নয়ন প্রচেষ্টার বাহিরে গিয়া গৃহবিবাদ মিটাইবার কাজে নামিতে হইল? উত্তরটি লুকাইয়া আছে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায়। কিছু কাল পূর্বেও এই ধরনের সাংসারিক অশান্তি প্রশমনের কাজটি করিতেন পরিবারের বড় কর্তা বা গিন্নি, পাড়ার প্রাজ্ঞ, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা অথবা গ্রামের মণ্ডল বা মাথা-রা। চার দেওয়ালের ভিতরের অশান্তি থানায় দোরগোড়ায় পৌঁছাইবার ভাবনাটি অজ্ঞাত ছিল। সক্ষম সন্তান বাবা-মা’কে না দেখিলে বা নাবালক সন্তানের উপর পিতা-মাতা অনাবশ্যক অত্যাচার করিলে এলাকাবাসীর শাসন ও নজরদারিই যথেষ্ট ছিল। বর্তমানে ‘দাপট’ কুক্ষিগত একমাত্র পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতাদের। ফলে অন্যায়কারীও তাঁহাদেরই কথা শোনে। এবং শোনে আদালতের কথা। আদালত অমান্য করিলে হাজতে ঢুকিবার ভয় আছে বলিয়াই। ব্যারাকপুরের ঘটনাটি ব্যতিক্রম নহে। প্রায় প্রতিনিয়ত সংবাদে প্রকাশ, বৃদ্ধ পিতামাতার উপর সন্তান, পুত্রবধূর উপর শ্বশুরবাড়ি বা স্ত্রীর উপর স্বামী অত্যাচার করিলে ন্যায়বিচারের জন্য প্রশাসন, নেতা এবং আদালতেরই দ্বারস্থ হইতে হয় এবং গণতন্ত্রের এই তিন স্তম্ভকে বরাদ্দ কাজটুকুর বাহিরে গিয়া ‘মিটমাট’ করাইবার গুরুদায়িত্বও লইতে হয়।
এবং নিজ শরীরে সমাজ সংস্কারকের নূতন পোশাকটি চাপাইতে হয়। এই নব প্রবণতা দেখিলে নিশ্চিত ভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়— কোনও দেশের প্রশাসন এবং আদালত কী কাজ করিবে, তাহা অনেকাংশেই নির্ভর করে সেখানকার সমাজব্যবস্থার উপর। যেখানে সামাজিক বন্ধনটি দৃঢ়, সেখানে উভয়েই নিজ অধিকারের বাহিরে পা রাখে না। কিন্তু গোড়া শিথিল হইয়াছে যেখানে, সেখানে শাসন ও বিচার বিভাগকে অগ্রসর হইতে হয় এবং প্রয়োজনে পারিবারিক চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করিতে হয় শিষ্টের পালন করিবার জন্য। একান্নবর্তী পরিবার ভাঙিয়া ক্রমে পরমাণু, প্রতিবেশীর নজরদারি ‘উটকো উপদ্রব’সম। সুতরাং, তুচ্ছ মনোমালিন্যেও পুলিশের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়, আদালতের নির্দেশ লাগে। এমন দিন আসিতে বিশেষ দেরি নাই, যখন ছেলে অঙ্কে ফেল করিলে দেশের প্রধানের ডাক পড়িবে।