প্রবন্ধ

এ ভাবে অচিরেই ফ্যাসিবাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাব

ইতিহাসই দেখিয়েছে, চরম দক্ষিণপন্থা একটি প্রতিপক্ষ খাড়া করে তার শেষ দেখে ছাড়ে। আমাদের দেশে এই প্রতিপক্ষের অন্তর্ভুক্ত হল দলিত, মুসলমান, বামপন্থী ও মুক্তমনা নাস্তিকেরা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অচিন বনায়ক-এর সঙ্গে কথা বললেন শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত।দেড় মাসের ওপর জেএনইউয়ের ছাত্র নজিব আহমদ-এর খোঁজ নেই। দু’টি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশনামা জারি করেছিল কেন্দ্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

ভরসা। নজিব আহমদ নিখোঁজ নিয়ে প্রতিবাদী মিছিল। মুম্বই, নভেম্বর

দেড় মাসের ওপর জেএনইউয়ের ছাত্র নজিব আহমদ-এর খোঁজ নেই। দু’টি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশনামা জারি করেছিল কেন্দ্র। সরকারি কর্মীদের কড়া ভাষায় বলা হয়েছে, তাঁরা সরকার-বিরোধী কোনও অবস্থান নিতে পারবেন না। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী নন্দিনী সুন্দর ও জেএনইউয়ের শিক্ষয়িত্রী অর্চনা প্রসাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। নোট বাতিলের কার্যক্রমকে ‘স্বৈরাচারী’ বলেছেন অমর্ত্য সেন। আমরা কি নগ্ন ফ্যাসিবাদের দিকে এগোচ্ছি?

Advertisement

আপনি যে পাঁচটি দৃষ্টান্ত দিলেন, সেগুলিকে স্মরণে রেখেই বলছি যে, এখনও সার্বিক, বিশুদ্ধ ফ্যাসিবাদ আমাদের দেশে কায়েম হয়নি। তবে বর্তমান বিজেপি সরকার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরম দক্ষিণপন্থী নীতি অনুসরণ করছে। এবং এই চরম দক্ষিণপন্থা আর উন্মুক্ত ফ্যাসিবাদের ভিতর দূরত্ব খুবই কম। এ ভাবে এগোলে আমরা অচিরেই ফ্যাসিবাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাব। এ প্রসঙ্গে যা লক্ষণীয়, তা হল, এই মুহূর্তে একাধিক দেশে ‘ফার রাইট’ সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে, তাদের শক্তিবৃদ্ধিও ঘটছে। যেমন ধরুন, জার্মানিতে ও ফ্রান্সে। কিন্তু এই দু’টি দেশেই চরম দক্ষিণপন্থীরা শাসকে পরিণত হয়নি। একমাত্র আমাদের দেশেই এরা শাসকের ভূমিকা পালন করছে এবং বিপদটা সেইখানেই। অর্থনীতি, বিদেশনীতি এবং সর্বোপরি ‘পাবলিক পলিসি’ বা জননীতি— প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বিজেপি সরকার চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি অনুসরণ করছে।

আরও খোলসা করে বললে, সমগ্র সঙ্ঘ পরিবার অন্তর থেকে চায় দেশে হিন্দু রাজ বা হিন্দুত্ববাদের শাসন কায়েম করতে। যে মুহূর্তে তাদের এই লক্ষ্য সাধিত হবে, সেই মুহূর্ত থেকেই আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের ভুক্তভোগী হব। আসলে, অতি দক্ষিণপন্থা এবং ফ্যাসিবাদের ভিতর নিবিড় সংযোগ রয়েছে, তাই এদের প্রতিরোধ করা আমাদের পুণ্য কর্তব্য। এটা অবশ্য ঠিক যে, শাসকরা খোলাখুলি হিন্দু রাজ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে না, কিন্তু মনে মনে এরা এই শাসন-রূপান্তরের পক্ষে। বর্তমানে এরা ‘টেস্টিং দ্য ওয়াটার’ বা জল মাপার কাজে নিয়োজিত।

Advertisement

অর্থাৎ, এক কথায়, পরিবারের মুখপাত্রেরা তাদের কথায় ও কাজে হিন্দু রাজ্য স্থাপনের সুস্পষ্ট আভাস দিয়ে যাচ্ছে এবং দেওয়ার পর এরা জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া মূল্যায়নের চেষ্টা করছে। যখনই এরা, যাকে বলে, গণসম্মতির পরিবেশ দেখবে, তখনই নেমে আসবে হিন্দু রাজ্যের কুঠার। বিস্তর ভাবনাচিন্তা করে তারা এক পা দু’পা এগোচ্ছে।

সঙ্ঘ পরিবারের একাগ্র নেতারা থেকে থেকেই এই সমীকরণের সমর্থনে মন্তব্য করছেন। অতীতেও করেছিলেন, বর্তমানেও করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।

ঠিকই। এই কাজে সব থেকে অগ্রণী ছিলেন গুরু গোলওয়ালকর। গৈরিক সদস্যরা এঁর নাম প্রকাশ্যে সে ভাবে নেয় না ঠিকই, কিন্তু পরিবারের অভ্যন্তরে এঁকে প্রায় পূজা করা হয়।

এই সতর্ক ভিতর-বাহির কেন?

কারণ, গোলওয়ালকরই সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যে, হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের নাৎসি আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ নাৎসিরা যে ভাবে ইহুদি নিধন যজ্ঞ পরিচালনা করেছিলেন, সে ভাবেই ভারতের মুসলমানের প্রতি আচরণ করতে হবে। আরও কিছুটা বিশদ ভাবে বললে, যারাই এই হিন্দুত্বের বিরোধিতা করবে, তাদের উপরেই নেমে আসবে নিপীড়নের খড়্গ। এই বিধ্বংসী নীতির রূপায়ণ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রত্যক্ষ বলপ্রয়োগ না হলেও বিবিধ অনুশাসনের চাপে বিরুদ্ধবাদীরা নাজেহাল। নাস্তিক ও সংশয়বাদীকে, বহু অসরকারি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে, বামপন্থী ও তাদের সমর্থকদের আইনের নিষ্ঠুর মারপ্যাঁচে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। এই আচরণবিধি একটি ঘোরকৃষ্ণ ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করছে। এই ঘৃণানির্ভর বিপজ্জনক প্রকল্প ও প্রক্রিয়া দলিতদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছে।

মুজফফরনগরে কয়েক দিনের মধ্যেই ষাট জন মুসলমানকে খতম করা হল, আজ পর্যন্ত সঙ্ঘ পরিবারের কোনও প্রতিনিধি ক্ষণিকের তরেও দুঃখপ্রকাশ করল না!

রাম জন্মভূমি আন্দোলনের পর্বে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর শত শত মানুষ শেষ হয়ে যায়, গুজরাত নিধন যজ্ঞে কয়েক দিনের ভিতর দু’হাজার মুসলমান নারী-পুরুষ শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কই, তখনও তো আনুষ্ঠানিক দুঃখপ্রকাশ করা হয়নি!

অনেকেই কিন্তু ভারতকে আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলছে না। এ দেশের মানুষ হয় ঘোর, ক্ষমাহীন স্মৃতিবিলুপ্তি দ্বারা আক্রান্ত, নয়তো তারা অন্তর থেকে সাম্প্রদায়িক।

আসলে চরম দক্ষিণপন্থা আর তার পরবর্তী দোসর ফ্যাসিবাদ— ইতিহাসই দেখিয়েছে— একটি কল্পিত, ভিন্ন প্রতিপক্ষ খাড়া করে এবং সেই প্রতিপক্ষ বা ‘আদার’-এর শেষ দেখে ছাড়ে। আমাদের দেশে এই প্রতিপক্ষের অন্তর্ভুক্ত হল দলিত, মুসলমান, বামপন্থী এবং মুক্তমনা নাস্তিকেরা। ক্রমাগতই এদের প্রান্তিক করে তোলা হবে। এদের একঘরে করা হবে, এদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের মাত্রাও বাড়বে। সঙ্ঘ পরিবারের অভীষ্ট হিন্দু রাষ্ট্রে এদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হবে।

কিন্তু অনেকেই তো এই ভয়াবহ পরিণতি চায় না। অনেকেই তো হিন্দু রাষ্ট্রের উপাসক নয়। এই পরিণতি কী ভাবে রোধ করা যেতে পারে?

এই পরিণতি রোধ করতে হবে সম্মিলিত বিরোধিতার মাধ্যমে। এবং এই বিশেষ ক্ষেত্রে এক দিকে কংগ্রেস ও অন্য দিকে বামপন্থীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি জানি, আমাদের দেশে বর্তমানে কমিউনিস্টদের অবস্থা আদৌ সুখকর বা সন্তোষজনক নয়। সংসদে মাত্র কয়েকজন বামপন্থী সদস্য টিমটিম করছে এবং পশ্চিমবঙ্গেও তারা মুখ্য বিরোধী নয়। এই ভগ্নদশা যে ভাবে হোক ঘোচাতেই হবে। আমি বামপন্থীদের পুনরুত্থানকে বিশেষ মূল্য দিই, কারণ সঙ্ঘ পরিবারের পরেই এই রাজনৈতিক গোষ্ঠী ক্যাডার-ভিত্তিক কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল। আরও সহজ করে বললে, সঙ্ঘপরিবারের ক্যাডার-ভিত্তিক রাজনীতি ঠেকাতে পারে একমাত্র কমিউনিস্ট ক্যা়ডার। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন যে, কমিউনিস্ট, কংগ্রেস ও লালুপ্রসাদ ছাড়া প্রায় অন্য সকল রাজনৈতিক দল কোনও-না-কোনও সময়ে বিজেপি-র সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সহযোগিতা করেছে। তার অর্থ আবার এই নয় যে, তাদের এই সংকটের পর্বে সরিয়ে রাখতে হবে। এই মুহূর্তে সব থেকে জরুরি হল মহাগঠবন্ধন নির্মাণ। প্রতিটি ধর্মনিরপেক্ষ দলকে এই বিরাট প্রয়াস ও পরিকল্পনায় অংশ নিতে হবে এবং প্রতিটি দলকে গড়ে তুলতে হবে ক্যাডার-নির্ভর সংগঠন। অতীব শক্তিশালী এবং দৃঢ় সংঘবদ্ধ সঙ্ঘ পরিবারের প্রসার ও বিস্তার রোধ করতে পারে এই সমবেত পরিকল্পনা ও প্রোগ্রাম। এবং আমি আবার বলছি, এই সমগ্র কার্যক্রমে কমিউনিস্টদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই রাজনীতি হবে দ্বিবিধ— স্বল্পমেয়াদি আর দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদির লক্ষ্য হবে মহাগঠবন্ধন করে নির্বাচনের লড়াইয়ে বিজেপিকে পরাস্ত করা। দীর্ঘমেয়াদির লক্ষ্য হবে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের অন্তরে-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হিন্দুত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার সমূল উৎপাটন। ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিস্টরা কমিউনিস্টদের পরাজিত করেছিল। আমরা কিন্তু আমাদের দেশে সেই বিয়োগান্ত পরিণতির পুনরাবৃত্তি চাই না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন