রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বললেন সমাজবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার

প্রশ্নটা তো অধিকারেরও

প্রথমেই বলা দরকার, উদ্বাস্তু গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের নীতি দীর্ঘ সময় জুড়ে একই রকম থাকেনি। এক দিকে ভারত সরকার তিব্বতি উদ্বাস্তুদের প্রভূত সাহায্য করেছে, এমনকী তাঁদের নিয়ে ইন্দো-টিবেটান সামরিক বাহিনী গঠন করেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

আবিশ্ব: ইরানের রাজধানী তেহরানে রাষ্ট্রপুঞ্জের অফিসের সামনে মায়ানমারে রোহিঙ্গা-নিপীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

প্রশ্ন: সবই ঠিকঠাক চলছিল। ভারতে কর্মরত রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র প্রদান করছিলেন এবং শরণার্থীরা এ দেশের একাধিক রাজ্যে, বিশেষ করে জম্মুতে আশ্রয় পাচ্ছিলেন। এমনকী একটি রোহিঙ্গা পরিবার খোলাখুলি জানিয়েছিলেন যে, স্বদেশে ভয়ংকর অতীতের তুলনায় তাঁরা ভারতে স্বর্গবাস করছেন। হঠাৎ ছবিটা আমূল পাল্টে গেল কেন?

Advertisement

রণবীর সমাদ্দার: প্রথমেই বলা দরকার, উদ্বাস্তু গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের নীতি দীর্ঘ সময় জুড়ে একই রকম থাকেনি। এক দিকে ভারত সরকার তিব্বতি উদ্বাস্তুদের প্রভূত সাহায্য করেছে, এমনকী তাঁদের নিয়ে ইন্দো-টিবেটান সামরিক বাহিনী গঠন করেছে। অন্য দিকে তারা উঠে পড়ে লেগেছে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের জন্য। এই দ্বিচারী নীতি কেন? দ্বিতীয়ত, ভারতের রোহিঙ্গা নীতি বৃহত্তর ভারত-মায়ানমার সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত। ভারত মায়ানমারকে যখন নিজের দিকে আনতে চায়, তখনই রোহিঙ্গা বিতাড়নের প্রশ্নটি মাথা চাড়া দেয়; আবার সম্পর্কে যখন টানাপড়েন দেখা দেয়, তখন আশ্রয়দানকে কেন্দ্র করে কোনও বড় প্রশ্ন দেখা দেয় না। আমরা, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর গবেষকরা এই অসংগতি নিয়ে বিস্তর ভেবেছি ও লিখেছি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সদ্য মায়ানমার থেকে ফিরেছেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের সমস্যা ও সংকট নিয়ে আউং সান সু চি-র সঙ্গে আলোচনাকালেই তিনি মায়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন জানান। রোহিঙ্গাদের ভারত থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত ও প্রয়াস এই পরোক্ষ মতৈক্যের সঙ্গে যুক্ত।

Advertisement

প্র: অনেকে বলেছেন, গত মাসের শেষের দিকে মায়ানমারের প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র রোহিঙ্গা মুক্তিকামীদের অভিযান ও তার ফলে বাহিনীর প্রতি-আক্রমণ দেশত্যাগের মাত্রা তীব্র ভাবে বাড়িয়ে দেয়।

উ: সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের কার্যক্রমের সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু তা বলে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করা হচ্ছে কেন? বস্তুত, বহু বছর ধরেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আঘাত বা প্রত্যাঘাত জারি রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জাইদ বিন রাদ আল-হুসেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, এই আক্রমণ ও নিপীড়ন ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা আর ‘এথনিক ক্লেনজিং’ বা জাতি বিলুপ্তিকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যাঁরা এখন গণহত্যার পরিণাম এড়াতে ভারতে এসে পৌঁছেছেন, তাঁদের আশ্রয়প্রদান আমাদের কর্তব্য। আমরা তিব্বতি শরণার্থীদের থাকতে দেব, শ্রীলঙ্কার তামিল উদ্বাস্তুদের সাহায্য করব, কিন্তু রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেব সেই জ্বলন্ত কটাহের দিকে, এটা কী রকম কথা? রোহিঙ্গারা মুসলিম বলেই কি বিজেপি সরকার এই মনোভাব গ্রহণ করেছে?

এটা ঠিক যে, মায়ানমারে জাতিনিপীড়ন বন্ধের উদ্দেশ্যে আলাপ আলোচনা শুরু করতেই হবে এবং সশস্ত্র দলগুলিকে এই আলোচনায় অংশ নিতে হবে। তা না হলে, সে দেশে যাঁরা শান্তি ও গণতন্ত্র চান তাঁরা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন এবং রাষ্ট্রীয় জঙ্গিবাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।

প্র: ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে পাকিস্তানের আইএসআই এবং লস্কর-এ-তইবা-র সঙ্গে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা ও লস্করের সদস্যদের নাকি একই শিবিরে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দাবি করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ভারতবাসের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গি জড়িত।

উ: এই অভিযোগের বাস্তব ভিত্তি কী আমার জানা নেই। তবে এটা বলাই যায় যে, এই বিশেষ ক্ষেত্রে দেশ বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসর্বস্ব বোধকে প্রয়োজনের অধিক মূল্য দেওয়া হচ্ছে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। এই ‘গেল গেল, ত্রাস ত্রাস’ রব, এই উগ্র নিরাপত্তাবোধের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদেরও ঘনিষ্ঠ সংযোগ। সব কিছু হারিয়ে-খুইয়ে স্রেফ বাঁচবার জন্য এসেছেন যাঁরা, সেই সব আশ্রয়হীন মানুষকে ‘এজেন্ট প্রোভোকেটর’ ভাবার আসলে কোনও অবকাশ নেই। আমি আবার বলব যে ইউএনএইচসিআর এই গভীর সংকট নিয়ে যা বলেছে তা মানবিক, যুক্তিগ্রাহ্য এবং গ্রহণযোগ্য।

কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদের ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক ‘কমপ্যাশন’ বা সহমর্মিতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার এই দ্বৈরথের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন, যদিও এখানে তথাকথিত দ্বৈরথের কোনও স্থান নেই। রাখাইন অঞ্চল থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে কী ভাবে বিঘ্নিত করছেন? আসলে, তাঁরা আমাদের সহমর্মিতা ও সমবেদনার প্রত্যাশী। মানবাধিকারের প্রশ্ন তো রয়েছেই, আশ্রয় পাওয়ার অধিকারও তাঁদের আছে।

প্র: ভারতের নিজস্ব কোনও উদ্বাস্তু নীতি নেই। থাকলে হয়তো আমরা এই সংকটকে অন্য চোখে দেখতে সক্ষম হতাম।

উ: ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রণীত উদ্বাস্তু কনভেনশন-এ সই করেনি, ফলে এমনিতেই জটিলতা আছে। তার উপর ভারতের নিজস্ব কোনও শরণার্থী সংক্রান্ত আইনও নেই। তবে তার মানে এই নয় যে, ভারতে আশ্রিত হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জবরদস্তি করে এই মুহূর্তে আবার বাঘের মুখে ঠেলে দিতে হবে। ভুললে চলবে না যে, এই ভারতই অতীতে বিভিন্ন বর্ণের, ধর্মের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। উপরন্তু, ভারত ইন্টারন্যাশনাল কোভেনান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটস-এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এই সরকারি সমর্থনই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিতাড়নের সম্ভাব্য যজ্ঞটিকে নীতিবহির্ভূত ও বেআইনি বলে চিহ্নিত করবে। আল-হুসেন ঠিকই বলেছেন, ‘‘ভারত পাইকারি বহিষ্কারের নীতি অনুসরণ করতে পারে না, (বিপন্ন) মানুষকে এমন জায়গায় (জোর করে) ফেরত পাঠাতে পারে না যেখানে তাদের অত্যাচারের ও অন্য নানা ধরনের অধিকারহানির ভয় আছে।’’ আশার কথা, দলাই লামা রোহিঙ্গাদের ভারতবাসের সমর্থনে কথা বলেছেন। মনে রাখতে হবে, মায়ানমারের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়ন করে চলেছে। এই আচরণ বৌদ্ধ দর্শন ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী। শ্রীলঙ্কায়ও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা হিন্দু তামিলদের নিপীড়ন করেছিল। এই অশুভ ও তীব্র জাতিধর্মভিত্তিক নিপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।

প্র: এই সংকটের নিরসন কী ভাবে সম্ভব?

উ: প্রথমেই যা অপরিহার্য, তা হল মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রীকরণ। মায়ানমারকে সেই দেশে পরিণত হতে হবে, যেখানে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিচারে প্রত্যেকে শান্তিতে ও সমমর্যাদায় থাকতে পারবে। রাখাইন-এর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকেও সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। অর্থাৎ ভারত চিন বাংলাদেশ তাইল্যান্ড মালয়েশিয়াকে সম্মিলিত প্রভাব বিস্তার করতে হবে, মায়ানমারকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে হবে যে জাতি-নিপীড়ন আঞ্চলিক সাম্য ও মৈত্রীকে বিঘ্নিত করছে। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার স্তর অতিক্রম করে বিশ্বের দৃষ্টি ফেরাতে হবে মায়ানমারের দিকে। বুঝতে হবে যে শুধু ভূমধ্যসাগরে নয়, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসমুদ্রেও শত শত নিরাশ্রয়, বিতাড়িত রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী-শিশু এখনও ভাসমান। তারা অভিশপ্ত বোট-পিপল বা নৌকা-বাসিন্দা। শেষ কথা, এই গভীর সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে দেরি না করেই ব্যাপক আলোচনা শুরু হওয়া দরকার, যাতে যোগ দেবে পশ্চিমি শাসক গোষ্ঠীও, যারা এত দিন ভূমধ্যসাগরে ভাসমান শরণার্থীদের নিয়েই ভাবিত ছিল। আন্তর্জাতিক স্তরে জনমত গঠন ও প্রচার নিঃসন্দেহে জরুরি। সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ নিয়ে যদি আলাপ-আলোচনা চলতে পারে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও তা শুরু হবে না কেন?

সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন