পোশাক-বিধির নামে এ কেমন আচরণ!

বেসরকারি বা সরকারি প্রায় সব স্কুলেই শৃঙ্খলার মধ্যে পোশাক-বিধি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এই পোশাক বিধি তৈরির সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ পোশাকের আভিজাত্যের উপর যে-ভাবে নজর দেন, সে-ভাবে হয়তো শীত-গ্রীষ্মের আবহাওয়ার প্রভাব ততখানি গুরুত্ব পায় না। লিখছেন সুকুমার দাস।বেসরকারি বা সরকারি প্রায় সব স্কুলেই শৃঙ্খলার মধ্যে পোশাক-বিধি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবক সকলেই জানেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৫৯
Share:

স্কুলে লেগিংস নিয়ে অভিভাবকদের বিক্ষোভ। ফাইল চিত্র

সম্প্রতি বোলপুরের এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রীদের ক্ষেত্রে পোশাক-বিধির দুঃখজনক যে ঘটনা আমরা দেখলাম, তা একই সঙ্গে অতীত-বর্তমানের বহু কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশে গ্রীষ্ম, শীত বা বর্ষা ঋতুর প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। বোলপুর-শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মে যেমন গরম, শীতে তেমনই ঠান্ডা। সে কারণে শুধু স্কুল-কলেজ নয়, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেও পোশাক ব্যবহারের মধ্যে একটা বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হয়। বড় ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরা সজাগ হওয়ায় পোশাক-বিধির ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই সচেতন থাকে। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের প্রভাব থাকাটা সেদিক থেকে খুবই স্বাভাবিক। সেটা বাড়িতেই হোক বা স্কুলে।

Advertisement

বেসরকারি বা সরকারি প্রায় সব স্কুলেই শৃঙ্খলার মধ্যে পোশাক-বিধি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবক সকলেই জানেন। কিন্তু এই পোশাক বিধি তৈরির সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ পোশাকের আভিজাত্যের উপর যে-ভাবে নজর দেন, সে-ভাবে হয়তো শীত-গ্রীষ্মের আবহাওয়ার প্রভাব ততখানি গুরুত্ব পায় না। কোনও কোনও স্কুল পশ্চিমী ভাবধারায় অতিশয় গর্ববোধে অভ্যস্ত। তবে আবহাওয়ার দিকে নজর রাখার গুরুত্ব সঙ্গত কারণেই অভিভাবকদের ক্ষেত্রে একটু বেশি। কারণ শিশুর শারীরিক সুস্থতা এক জন বাবা-মা যতটা খেয়াল করবেন, শিক্ষক-শিক্ষিকারা সে খেয়াল রাখার কথা মাথায় রাখেন না। সন্তানের প্রতি সেই খেয়াল রাখার কারণেই বোলপুরের ওই স্কুলের বাচ্চা মেয়েদের স্কার্টের সঙ্গে লেগিংস পরিয়ে পাঠিয়েছিলেন কয়েক জন অভিভাবক। শীতের শুরুতে বাচ্চাদের যাতে ঠান্ডা না লাগে, সেই উদ্বেগ থেকেই বাবা-মায়েরা এই কাজ করেছেন। কিন্তু, তা নিয়েই ঘটে গেল গেল কী বিষম কাণ্ড! যা হওয়াটা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়।

অথচ প্রায় একশো বছর আগে একটা সময় ছিল, শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই সঙ্গে স্কুলের শিক্ষক আর বাড়ির অভিভাবক— এই দু’প্রকার কর্তব্যেরই সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। সময় বদলেছে, পরিস্থিতি বদলেছে, কাজের পরিসর পরিবর্তিত হয়েছে। এত সব পরিবর্তনের মধ্যে বদল এসেছে মানবিকা বোধেও। কী ভাবে এই বোধ নিয়ে তিলে তিলে রবীন্দ্রনাথ পাঁচ ছাত্রের বিদ্যালয় থেকে একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন— তা ভাবলে বড়ই বিস্ময় জাগে! রবীন্দ্রনাথের আর্থিক সামর্থ্য ছিল যৎসামান্য, যাঁরা তাঁর অভিযানের সহযাত্রী, তাঁদেরও সহায় সম্বল কিংবা চাহিদা ছিল নামমাত্র। তাই কবির দরদি নেতৃত্ব আর পরিকরদের উদার সহযোগিতা বছরের পর বছর ধরে ব্রহ্মবিদ্যালয়কে বিশ্বভারতীর মতো মহীরুহে উন্নীত করেছিল।

Advertisement

কেমন ছিল কবির নেতৃত্ব? বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নিয়ে তাঁর উদ্বেগ আর চিন্তা ভাবনা ছিল দৈনন্দিত কর্মপ্রবাহের অন্যতম প্রধান বিষয়। শান্তিনিকেতনে থাকলে শিশুদের পঠন-পাঠন, খাওয়া-পড়া, খেলা-ধূলা, অসুখ-বিসুখে পরিচর্যা— এ সব নিজেই দেখভাল করতেন। বাইরে থাকলে আবহাওয়ার প্রভাব বিষয়ে আগাম সতর্ক করে পড়ুয়াদের দেখাশোনার নির্দেশ দিতেন। কোনও ছাত্র অসুস্থ থাকলে নিয়মিত খবরাখবর নিয়ে যথার্থ ওষুধ-পথ্য আর সেবার নির্দেশ দিতেন। ভূপেন সান্যালকে লেখা কবির এরকম একটি চিঠির উল্লেখ এখানে যথার্থ প্রাসঙ্গিকতা বহন করবে। কবি লিখছেন : “... দেবলের কাসির জন্য উদ্বিগ্ন আছি। তাহার বুকে পিঠে গরম সর্ষের তেল মালিশ করিয়া দিবেন ও steam bath দেওয়াইবেন। মালিশ ও স্নানের সময় যেন ঠাণ্ডা না লাগে। অক্ষয় কেমন আছে? ... স্নিগ্ধ ব্যবহার যে ছেলেদের পক্ষে বিশেষ উপকারী তাহাতে সন্দেহ নাই— চেষ্টা করিয়া দেখিবেন অরবিন্দকে যদি কোমল ব্যবহারে বশ করিতে পারেন।”

এর থেকেই স্পষ্ট, সেই যুগেও রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের খুঁটিনাটির বিষয়ে কতটা নজর দিতেন! কবি যখন ভূপেনবাবুকে এই চিঠি লিখছেন, তখন শান্তিনিকেতনে শীত শুরু হচ্ছে। তাই আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত মাস্টারমশাইকে আগেই সতর্ক করে দিতেন। এই নির্দেশ বা পরামর্শ কিন্তু সার্বিক ভাবে সকল পড়ুয়াদের জন্য। কবি বলছেন : “তীব্র শীতের হাওয়া বহিতে আরম্ভ করিয়াছে, এই সময় ছেলেদের স্বাস্থ্যের প্রতি একটু বিশেষ সতর্ক হইবেন। স্নানের সময় আপনারা কেহ উপস্থিত থাকিয়া ইহাই দেখিবেন যে স্নানের সময় তেল মাখিতে জল ঢালিতে কেহ যেন অনাবশ্যক বিলম্ব না করে।... উপাসনার বস্ত্রের সঙ্গে একটা গরম কাপড় পরা বিশেষ দরকার। স্নানের পর ঠাণ্ডা লাগানো কোনো মতেই হিতকর নহে। ... ছেলেদের সর্দি হইলেই রাত্রে পায়ের তেলোয় গরম সর্ষের তেল মালিশ করান উচিত।”

খুব স্বাভাবিক কতগুলি কারণে আজকের স্কুলগুলিতে এই সাদৃশ্য পাওয়া যাবে না, আশা করাও সঙ্গত নয়। প্রথম যে বড় কারণ সেটা হল, কবি বা তাঁর সহকারীরা তখন পড়ুয়াদেরকে সন্তান মনে করতেন, আর নিজেরা যথার্থই পিতৃত্বের দায়ভার নিয়ে আশ্রমের কাজে শামিল হতেন। অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করার মতো মহানুভবতার অধিকারী ছিলেন তাঁরা। পড়ুয়াদের শীত-উষ্ণ বোধকে নিজের অনুভূতি দিয়ে বিবেচনা করতেন। সে কারণেই কবির অনুমোদন ছিল ‘উপাসনার বস্ত্রের সঙ্গে একটা গরম কাপড় পরা’। আমরা জানি শান্তিনিকেতনে ক্লাসের সময়, খেলার সময় কিংবা উপাসনায় অংশগ্রহণের সময়ও একটা পোশাক-বিধির শৃঙ্খলা ছিল, আজও তা একই রকম। সেই শৃঙ্খলা বজায় রেখেই কবি এমন এক বিধান দিয়েছিলেন— যাতে অকারণে শুধু গৌণ দিকটি মুখ্য না হয়ে ওঠে। আগে শারীরিক মানসিক সুস্থতা, তারপরে পড়াশোনা বা প্রার্থনা ইত্যাদি। এ কালে এর কোনওটিই সেভাবে গুরুত্ব পায় না— এটাই সব থেকে দুঃখের!

বলতে দ্বিধা নেই, আজ আমরা যে পথে চলেছি, মনুষ্যত্বের একটা চরম অবক্ষয় প্রতি মুহূর্তে স্বীকার করে নিয়ে আপস করছি। ক্লাস ওয়ানে পড়া কিছু শিশুছাত্রীকে স্কুলের পোশাক-বিধি শেখানোর জন্য, কিংবা তাদের অভিভাবককে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পোশাকের একটা অংশ খুলিয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় বাড়ি পাঠানো হল। কিন্তু, ভেবে দেখার বিষয় এই যে, এই সমস্যার সমাধানের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে অনেক রকমের সহজ সমাধান ছিল— এ কথা যে কেউ স্বীকার করবেন। তা না করে শৃঙ্খলার এই অতিশয় ভয়ঙ্কর পাঠ এক সঙ্গে কতগুলো ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুর মনে এমন এক আতঙ্ক বাসা বাধালো, যা বড় হয়েও হয়তো তাদেরকে তাড়া করবে। একই সঙ্গে নিরুপায় অভিভাবকদেরকে শিখিয়ে দেওয়া হল মিডিয়ার কাছে এক মহা মিথ্যা কথা বলতে যে ‘গরমের জন্য বাচ্চারা নিজেদের পোশাক খুলে ফেলেছে’।

অর্থাৎ, একটা অন্যায়কে ঢাকতে আর একটা মিথ্যার আশ্রয়! সাধারণ জনতার আবেদনে সাড়া দিয়ে জেলাশাসক ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত কেন, সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হয়ে প্রত্যক্ষ তদন্ত বা বিচার হতে পারত। জেলাশাসক অনুপস্থিত থাকলে অন্য কোনও শাসক চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এর সমাপ্তি ঘটাতে পারতেন। তদন্তে হয়তো দেখা গেল কোনও এক শিক্ষয়িত্রী ক্রোধের বশে এই ভুল করেছেন। শাস্তিস্বরূপ তাঁকে স্কুল থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু এ রকম অজস্র স্কুল বীরভূম বা এ রাজ্যে ছড়িয়ে আছে। তিনি হয়তো অন্য কোথাও কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু, জাতির সেবায় নিয়োজিত শিক্ষক সমাজের লজ্জায় মাথা হেঁট তো হল!

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যে শিশুরা ভয়ে স্কুল যেতে চাইছে না, তারা এই হৃদয়হীন নিষ্ঠুর স্মৃতিকে ভুলে যেতে পারবে তো?

লেখক রবীন্দ্র-গবেষক ও বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের কর্মী, মতামত নিজস্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন