উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা নিয়ে কত লেখাই তো হয়েছে কত সময়। মন ভাল করার জন্য উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটের জুড়ি নেই। সহজ-সরল জীবন আর মন-মাতোয়ারা নিবিড় বনানীতে উত্তরবঙ্গের একদম উত্তরের জেলাগুলি সব সময়ই ভ্রমণার্থীদের হাতছানি দেয়। অথচ, এই নিবিড় সৌন্দর্যের মধ্যেও রয়েছে মনখারাপের নানান দৃশ্য। রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করার জীবন। কচি হাতে খেলাধুলোর জিনিস না নিয়ে যন্ত্র-সারাইয়ের হাতুড়ি আর স্ক্রু-ড্রাইভার তুলে নেওয়ার বাস্তবতা। জে এম ব্যারির ‘নেভারল্যান্ড’ যে শুধু গল্পেই থাকে! তাকে কি আর সত্যিই খুঁজে পাওয়া যায়?
দিনকয়েক আগেই হঠাৎ-প্রয়োজনে জলপাইগুড়ি যেতে হয়েছিল। বাস ইসলামপুরে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়াতেই চোখে পড়ল যে, সাত-আট বছরের দু’টো বাচ্চা ছেলেমেয়ে পিঠের বস্তায় রাস্তা থেকে কুড়োনো যাবতীয় বাতিল হওয়া জিনিসপত্র বোঝাই করে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছেঁড়া, অপরিস্কার জামা, রুক্ষ মাথার চুল। কিন্তু মুখ দু’টি মায়াময়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছু করার আগেই বাস এগিয়ে চলে। বসে বসে ভাবলাম, মহান মনীষীরা কোন কালে বলে গিয়েছেন যে, শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই রকম আরও কত শত শিশু রয়েছে, যাদের বর্তমানই ঘোর অন্ধকারে। চার দিকে বিভিন্ন শিশুশ্রম দূরীকরণ সংস্থাগুলি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই অমানবিক বিষয়টিকে পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য। কিন্তু ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সব জায়গায়, সর্বদা তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরবঙ্গের কথা আর আলাদা করে কীই-বা বলা যাবে! বাস্তব ক্ষেত্রে, পুরো ভারতেই বিভিন্ন হোটেল-রেস্তরাঁ, ফাস্ট ফুডের দোকানে কর্মরত অবস্থায় প্রায়শই দেখা মেলে কচি মুখগুলোর। শৈশব বিসর্জন দিয়ে কঠোর জীবনসংগ্রামে নিয়োজিত। চরম ব্যস্ততার কারণে বেশির ভাগ মানুষেরই সে বিষয়ে দৃকপাত করার সময় নেই। আইন মোতায়েন থাকা পরেও তার তোয়াক্কা না করে মাঝে মাঝেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা নিযুক্ত হচ্ছে। অন্য দিকে, এদিক ওদিক নজর ফেললেই চোখে পড়বে, হয়তো রিকশা চালাচ্ছে যে ছেলেটি, তার গোঁফের রেখা উঠতে এখনও ঢের দেরি।
আজ থেকে এক শতাব্দীরও বেশি আগে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জার্মান অর্থনীতিবিদ শ্রমিকদেরকে ‘হ্যাভ-নটস্’-এর পর্যায়ে ফেলে, এঁদের শোষিত হওয়ার কথা ব্যাখ্যা করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকেরা যে প্রান্তিকতার কোন পর্যায়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর শহর রায়গঞ্জেও এই শিশুশ্রমিকদের দেখা মেলে হঠাৎই। রেস্তরাঁর ধোঁয়ায় বা মোটরসাইকেল সারাইয়ের দোকানে কালিঝুলি মাখা মূর্তিগুলি দেখলে ল্যাম্ব সাহেবের ‘অন দ্য প্রেজ অব দ্য চিমনি সুইপারস’-এ বর্ণিত সেই অপ্রাপ্তবয়স্ক অ্যাপারিশনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। যদিও রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে যতটা সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এদের সামাজিক সুরক্ষা আর সম্মান এনে দেওয়ার। আশা করা যায়, নিশ্চয়ই কিছু বছর পরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নানা দিকে চোখ ফেললে হয়তো আর খুঁজে পেতে হবে না এই ম্লান মুখগুলিকে। কারণ, তারা তখন সবাই স্কুলে ব্যস্ত।
বর্তমান বিশ্বে শিশুশ্রম একটি জ্বলন্ত সমস্যা। আর উত্তর দিনাজপুরে তো বটেই। নভেম্বর ২০১২ সালে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উত্তর দিনাজপুর জেলায় শিশুশ্রমিকের সংখ্যা তখন নেহাৎ কম ছিল না। প্রায় ৫২,৯২৮। কখনও চরম দারিদ্রের কবল থেকে মুক্ত হতে, কখনও-বা জোরপূর্বক শিশুদের শ্রমিকে পরিণত করা হয়। বিড়ি কারখানা, ইটভাটা, ফ্ল্যাট ও বাড়ি তৈরি, গ্যারেজ— এ ছাড়া হোটেল-রেস্তরাঁ প্রভৃতিতে কাজে শিশুদের লাগিয়ে দেওয়া হত উত্তরের বিভিন্ন জেলাগুলিতে। শারীরিক-মানসিক দিক থেকেও তারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ত। একে কয়েকবছর আগে অবধি উত্তর দিনাজপুর জেলা বহু দিক থেকে অন্যান্য জেলার তুলনায় অবহেলিত ছিল। এর উপর শিশুশ্রমিকের সংখ্যা যদি বাড়তে থাকে, তবে সেই জেলাটির পিছিয়ে পড়ার মাত্রাও ক্রমশ বাড়তে থাকবে।
এই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শিশুশ্রমিকের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার লাগাতার প্রয়াস শুরু করেছে। সুফলও মিলছে হাতেনাতে। এই মুহূর্তে উত্তর দিনাজপুরে শিশুশ্রমিকদের সংখ্যাটা উল্লেখজনক ভাবে কমছে ক্রমশ। যে সব জায়গায় শিশুশ্রম একেবারেই রোধ করা সম্ভব নয়, সেখানকার প্রান্তিকতা আর অর্থনৈতিক কারণে, সেখানে বেসরকারি আর সরকারি সংস্থাগুলি ব্যবস্থা করেছে, যাতে কর্মরত অপরিণত মানুষগুলো ঠিকঠাক কাজের ঠিক মজুরি পায়। আর যাতে পায় পড়তে যাওয়ার সুযোগ। একটু ভাল খাওয়া-পরা আর পড়াশোনার সুযোগ। (শেষাংশ আগামিকাল)
(লেখক রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)