গণরোষের উৎস

এই প্রশ্রয় বিচ্ছিন্ন নহে, ইহাই এখন রীতি, বিশেষত অপরাধীরা যদি শাসকের ঘরের লোক হয়। গোহত্যার প্রতিবাদের নামে গণপ্রহারে হত্যা, ‘ধর্মদ্রোহী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ তকমা সাঁটিয়া লেখক-সাংবাদিক-চিত্রনির্মাতাদের উপর নির্যাতন পর পর ঘটিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্যরা অপরাধীদের রুখিতে তৎপর হন নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share:

গণপ্রহারে মৃত্যু নূতন নহে। কিন্তু সরকারি প্রকল্পের ‘বিরোধিতা’ করিবার জন্য গণপ্রহারে প্রাণ খোওয়াইবার ঘটনা নূতন বটে। সম্প্রতি রাজস্থানে অভিযোগ উঠিয়াছে, প্রতাপগড় পুরসভার কর্মীদের প্রহারে মৃত্যু হইয়াছে এক প্রৌঢ়ের। তাঁহার অপরাধ, পুরকর্মীরা বস্তির প্রাতঃকৃত্যরত মহিলাদের ছবি তুলিতে গেলে তিনি বাধা দিয়াছিলেন। সেই জন্য নির্দয় ভাবে মারধর করা হয় তাঁহাকে। এই ‘গণপ্রহার’-এর স্বরূপটি লক্ষণীয়। ইহা ছেলেধরা, পকেটমারের উপর ক্ষিপ্ত জনতার আক্রমণ নহে, সরকারি কর্মীর দুর্নীতি-অবহেলায় ধৈর্যচ্যুতি নহে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি দেখিয়া ক্রোধে উন্মত্ততা নহে। জাতপাত বা ধর্মের ভিত্তিতে যে ধরনের সংঘর্ষ দেখিতে এ দেশ অভ্যস্ত, এই গণপ্রহার সেই পঙ্‌ক্তিভুক্তও নহে। ইহা যেন একটি নূতন শ্রেণির অপরাধ। এমন অন্যায় করিলেও প্রশাসন কিছু বলিবে না, বরং প্রশ্রয় দিবে— সেই আশ্বাস এই গণহিংসার উৎস। তাহারই ভিত্তিতে রীতিমতো ঠান্ডা মাথায় সংগঠিত ভাবে এই ধরনের অপরাধ ঘটিতেছে।

Advertisement

এই প্রশ্রয় বিচ্ছিন্ন নহে, ইহাই এখন রীতি, বিশেষত অপরাধীরা যদি শাসকের ঘরের লোক হয়। গোহত্যার প্রতিবাদের নামে গণপ্রহারে হত্যা, ‘ধর্মদ্রোহী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ তকমা সাঁটিয়া লেখক-সাংবাদিক-চিত্রনির্মাতাদের উপর নির্যাতন পর পর ঘটিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্যরা অপরাধীদের রুখিতে তৎপর হন নাই। যদি বা দু’চারটি নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করিয়াছেন, তাহা অতি বিলম্বে। গোরক্ষার নামে নির্যাতনকারী, এমনকী হত্যাকারীদেরও বহু ক্ষেত্রে গ্রেফতার করা হয় নাই। অতএব আইন হাতে তুলিয়া লইবার কাজটির ঝুঁকি কমিয়াছে, আকর্ষণ বাড়িয়াছে। সরকার কী সমর্থন করে, আর কী করে না, তাহা আর স্পষ্ট নহে। মহিলাদের মর্যাদা রক্ষা করিতে চাই শৌচাগার, এমনই প্রচার করা হইয়াছিল স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে। কিন্তু যে মহিলারা শৌচাগার ব্যবহারে অপারগ বা অনাগ্রহী, তাঁহাদের অমর্যাদা করিবার কাজটিও কি প্রকল্পের অঙ্গ? অথচ সেই কাজটি দেশ জুড়িয়া নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তারা উৎসাহভরে করিয়া চলিয়াছেন। কোনও এক কল্পিত, অস্পষ্ট মতবাদকে কখনও ধর্ম, কখনও জাতীয়তা বলিয়া দাবি করিয়া অনায়াসে উৎপীড়ন, এমনকী হত্যা পর্যন্ত হইতেছে।

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বরাবরই নাগরিককে বিপন্ন করিয়াছে। ভীতিপ্রদর্শন করিয়া নেতাদের প্রভাব বাড়াইতে, দলের জন্য সমর্থন আদায় করিতে, কিংবা নিছক তোলাবাজি করিতে নেতারা বরাবরই দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করিয়াছে। সেই দুর্বৃত্তরা কেহ কেহ স্বয়ং নেতা হইয়া বসিয়াছে, এমন দৃষ্টান্তও কম নাই। কিন্তু এখন দুর্বৃত্তায়নের যে নূতন পর্ব শুরু হইয়াছে, তাহা দলীয় বিরোধিতায়, রাজনৈতিক অবস্থানে, এমনকী অর্থের লালসাতেও সীমাবদ্ধ নাই। নিতান্ত নাগরিক পরিসরে, এমনকী ব্যক্তিগত পরিসরেও ভিন্ন মতকে দমন করিতে সংগঠিত হিংসার প্রয়োগ হইতেছে। কে তাহার আয়োজক, কে সমর্থক, তাহার ঠিক নাই। নিশ্চিত শুধু প্রশাসনের নির্বিচার পৃষ্ঠপোষকতা। দাবি কেবল প্রশ্নহীন আনুগত্য। দাদরিতে গৃহস্থের হেঁশেলে হানা দিয়া শুরু হইয়াছিল তাহার প্রকোপ। প্রতাপগড়ে তাহা পৌঁছাইল বস্তিবাসীর শৌচকর্মে। বৃত্ত কি সম্পূর্ণ হইল?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন