মানবসেবায় ব্রতী এক বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী

স্বদেশচেতনা ও মানবসেবার অপর নাম মুহম্মদ কুদরত এ খুদা, এক বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী। পৈতৃক নিবাস মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান সীমানাবর্তী মৌগ্রাম। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, গ্রেট ব্রিটেন জুড়ে তাঁর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত ছিল। লিখছেন দেবযানী দাস সিংহ।পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় গবেষণা কেন্দ্রে তিনি মোট আঠারোটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এ গুলি পাকিস্তান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চে প্রকাশিত হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৯ ০২:৫৯
Share:

বিজ্ঞানী মুহম্মদ কুদরত এ খুদা। ছবি সৌজন্যে লেখক।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ। সময়কাল ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখ (১৯০০ সালের ১০ মে)। বীরভূমের মাড়গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মালেন হজরত সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দাকার আব্দুল মুকিদ এবং সৈয়দা ফাসিয়া খাতুনের সন্তান মুহম্মদ কুদরত এ খুদা। স্বদেশচেতনা ও মানবসেবার অপর নাম মুহম্মদ কুদরত এ খুদা, এক বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী। পৈতৃক নিবাস মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান সীমানাবর্তী মৌগ্রাম। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, গ্রেট ব্রিটেন জুড়ে তাঁর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। এই বীরভূমের মাটিতেই তাঁর জন্ম – শিক্ষার শুরুও এখানে। তিনি দেশকে গর্বিত করেছেন, ধন্য করেছেন বীরভূমকে।

Advertisement

বাবা আব্দুল মুকিদ সে যুগের ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির স্নাতক। সে যুগে ইংরেজি জানা মানুষের পক্ষে ইংরেজ সরকারের অফিসে চাকরি খুব সহজেই পাওয়া যেত । কিন্তু খোন্দাকার আব্দুল মুকিদ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকতেই পছন্দ করতেন। কলকাতার তালতলায় এক পীরের তিনি শিষ্য ছিলেন। স্থানীয় মানুষ তাঁকেও পীর হিসেবে মান্যতা দিতেন।

পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় গ্রাম মাড়গ্রাম। ১৮৮১ সালে এই গ্রামে একটি অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল এম.ই. স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলেই কুদরত এ খুদার লেখাপড়া শুরু। এর পরে কলকাতায় এসে ১৯১৮ সালে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি পরীক্ষায় প্রথম হলেন। এই রকম রেজাল্ট, আর একই সঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বঞ্চিত করা হল। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেলেন না। ব্রিটেনে গিয়ে অধ্যাপক জে.এফ.থর্পের কাছে গবেষণা করে মুহম্মদ কুদরত ১৯২৯ সালে ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি পেলেন। ভারতীয় মুসলিম সমাজে তিনিই প্রথম ডি.এস.সি – গোটা দেশের নিরিখে অষ্টম ডি.এস.সি। লন্ডন থেকে তিনি ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি’তেও ডক্টরেট হলেন। এ কাজ খুব সহজে হয়নি। রাষ্ট্রীয় বৃত্তি পাওয়া নিয়েও সমস্যা হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দরখাস্ত করতে বললেও তা অজ্ঞাতকারণে নামঞ্জুর হয়। তখন স্যর আবদার রহিমের হস্তক্ষেপে ‘রাষ্ট্রীয় বৃত্তি’ পেলে তিনি গবেষণার জন্য বিলেত যান। শোনা যায় থর্প সাহেব আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে পছন্দ করতেন না বলে তাঁর ছাত্র মুহম্মদ কুদরতকেও দেখতে পারতেন না। পরে ছাত্রের গুণ দেখে তাঁকে কাছে টেনে নেন। কলকাতায় কুদরতের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়। উপস্থিত ছিলেন দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, স্বদেশি গানের গায়ক নলিনীকান্ত সরকার।

Advertisement

১৯৩১ সালে কুদরত সাহেব প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হলেন। ’৩৬-এ রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক। ১৯৪২-’৪৪ সালে ইসলামিয়া কলেজ, বর্তমানের মৌলানা আজাদ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরে কুদরত সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। পূর্ব পাকিস্তানের জনশিক্ষা দফতরের পরিচালক ছিলেন ১৯৪৭- ’৪৯ পর্যন্ত। বাংলা ভাষাকে নিয়ে চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি লিগ সরকারকে সমর্থন করেননি। বাঙালি হয়ে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষেই সওয়াল করেন। ফলে চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। তবে ১৯৫০-’৫৩ এই সময়কালে খানিকটা বাধ্য হয়েই পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা করতে বাধ্য হল এই সময়ে বহু বিজ্ঞান সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর যোগ্যতাকে অস্বীকার করার উপায় পাকিস্তানের লিগ সরকারের ছিল না। ’৫৩-’৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। পাকিস্তান সরকার বিজ্ঞান ও শিল্প সংক্রান্ত গবেষণার জন্য যে কেন্দ্র স্থাপন করে,

তার দায়িত্বও মুহম্মদ কুদরত এ খুদার উপরেই পড়ে। ১৯৬৬ সালে ওই পদ থেকে তিনি অবসর নিলেও ১৯৬৮ সালে তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। স্বৈরাচারী সামরিক সরকার তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টি করলে তিনি পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশের জন্ম হলে নতুন দেশে তিনি ১৯৭২-’৭৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন। তিনি তাঁর প্রতিবেদনে তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষার রূপরেখা সম্বন্ধে অত্যন্ত মূল্যবান মতামত দিয়েছিলেন ।

তাঁর নিরলস বিজ্ঞান চর্চার ও গবেষণার কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল, তা সে অবিভক্ত ভারতেই হোক বা পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ— কৃষি, শিল্প বা খনিজ, জলসম্পদকে কাজে লাগিয়ে কী ভাবে দেশকে সমৃদ্ধ করা যায়, সেই ভাবনাতেই তাঁর গবেষণার ধারাটিকে অব্যাহত রাখতেন। তাঁর গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল দেশ ও সমাজের সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন। তিনি অবিভক্ত ভারতে ১৯২৬-’৪৭ সাল পর্যন্ত বিশুদ্ধ রসায়নের ক্ষেত্রে একুশ বছরে একুশটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। Ketolactal Tautomerism-এর গবেষণা সাড়া ফেলে দেয়। এ বিষয়ে তিনি মোট ৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। পাঁচটি প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব কেমিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন-এ। আর শেষেরটি ১৯৪৭-এ প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটিতে ।

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় গবেষণা কেন্দ্রে তিনি মোট আঠারোটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এ গুলি পাকিস্তান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অনেকগুলি পেটেন্ট আছে। তাঁর মধ্যে পাট সংক্রান্ত ন’টি। পাট থেকে সুতো, পাট বীজ থেকে তেল, পাটের অপজাত থেকে রেয়ন, পাটকাঠি থেকে বোর্ড ও কাগজের মন্ড ইত্যাদি। চিটেগুড়, তালের গুড় থেকে সুক্রোজ, ভিনিগার, ল্যাকটিক অ্যাসিড প্রভৃতির চারটি পেটেন্ট আছে। বিড়ির পাতার বিকল্প হিসাবে

কুন্ডিপাতা ব্যবহারের পেটেন্ট নিয়েছিলেন তিনি। নাটাকরঞ্জ, তেলাকুচা, তুলসী, বিষ কাঁঠালি, কালমেঘ, সিনকোনা, গুলঞ্চ নিয়েও তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা আছে ।

বিজ্ঞান সাধনা দিয়ে দেশের সেবা করেছেন মুহম্মদ কুদরত এ খুদা। তিনি যুদ্ধোত্তর বাংলার ‘কৃষি-শিল্প’ নামে অসামান্য একটি বই লেখেন। তিয়াত্তর পাতার ওই বই বিশ্বভারতী প্রকাশনার ‘বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকাশনায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দের ১ চৈত্র (’৪৩ সালের মার্চ) প্রকাশিত হয়। কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে বইটি অসামান্য দলিল।

মুহম্মদ কুদরত এ খুদা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রবক্তা। ১৯৩৯ সালে ‘বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনি’ লিখেছিলেন। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, অসমিয়া, উর্দুতে ওই গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। তিনি রসায়ন শাস্ত্রে এম.এস.সি-র ছাত্রছাত্রীদের জন্যও বাংলায় বই লিখেছিলেন। তাঁর অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যা উনিশ। পাকিস্তান সরকার ও পরবর্তী কালে বাংলাদেশ সরকার বিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বহু পদবি ও পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘একুশে পদক’ পান। আন্তর্জাতিক বহু সংস্থার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

এ রাজ্যেও বিজ্ঞান মঞ্চ পরিচালিত ‘ড. কুদরত-এ-খুদা গ্রামীণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশ কেন্দ্র’ গড়ে উঠেছিল নয়ের দশকে ।

১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় এই মানব প্রেমিক বিজ্ঞান সাধক প্রয়াত হন। স্বদেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের প্রতি এক নিষ্ঠ সাধনার মেলবন্ধন তাঁকে অনন্য সাধারণ করে তুলেছে।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

লেখক স্কুলশিক্ষিকা ও সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন