প্রবন্ধ ২

রূপ দেখলে চুপ?

রূপের প্রতি মুগ্ধতা মানুষের এক্কেবারে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মেয়েরাও রূপের দিকে গোল্লা-হাঁ তাকায়। পুরুষচাউনির চেয়ে কিচ্ছুটি কম নয় সে লোভদৃষ্টি। কী সাংঘাতিক মুশকিলের দেশ হল রে! বীরাপ্পনকে নিয়ে ছবি করলে বলছে দুষ্কৃতী ভাঙিয়ে পয়সা করছ কেন? আবার মহিলা রাজনীতিকের রূপের প্রশংসা করলে চটেমটে চেঁচাচ্ছে: পুরুষ শভিনিস্ট শূকর! আরে, বীরাপ্পনকে নিয়ে ছবি করব না কেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০০:০১
Share:

কী সাংঘাতিক মুশকিলের দেশ হল রে! বীরাপ্পনকে নিয়ে ছবি করলে বলছে দুষ্কৃতী ভাঙিয়ে পয়সা করছ কেন? আবার মহিলা রাজনীতিকের রূপের প্রশংসা করলে চটেমটে চেঁচাচ্ছে: পুরুষ শভিনিস্ট শূকর! আরে, বীরাপ্পনকে নিয়ে ছবি করব না কেন? ‘গডফাদার’ দেখে হামলে হোঁচট খাচ্ছিস, মার্লন ব্র্যান্ডোকে দেখে লাল পড়ছে, সে বেলা পলিটিকালি কারেক্ট প্রশ্নগুলো গজাচ্ছে না? শুধু আমি গ্যাংস্টার নিয়ে ছবি করলেই মনে হচ্ছে, ভায়োলেন্সকে চমকপ্রদ লেন্স দিয়ে গৌরব-মাখামাখি করছি? ছবিতে খুব মারামারি থাকলেই হিংসাকে গ্লোরিফাই করা হয়? তা হলে বাপু ডিসকভারি চ্যানেল আর অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটকে নিষিদ্ধ করার জন্যে প্ল্যাকার্ড বাগিয়ে নামছ না কেন? একের পর এক সিনে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রাণীকে টুঁটি কামড়ে গপাগপ! প্ররোচনাহীন নৃশংসতা! জাস্ট একটা বলশালীর খিদে পেয়েছে বলে নিরীহ প্রাণ সাবাড়! দেখে ইস-ইস ঢঙে শিউরে উঠছ আবার চিতাবাঘের লীলায়িত জিগজ্যাগ থেকে চোখ ফেরাতে পারছ না, উঁহু, সেরেফ রুদ্র-ঝলকানির জন্য নয়, বীভৎস পরিণতিটা দেখতে তব সত্তা ছুটো সেলোটেপের ন্যায় চিপ্‌কুরাম! শিল্প এ জিনিসকে ব্যবহার, উদ্‌যাপন, ব্যবচ্ছেদ করবে না? তা ছাড়া, হিংসায় থিকথিক পৃথ্বী, রোজ কাগজ আসছে হিংসার দশ কিলো মুখে নিয়ে, বাস্তব নিয়ে কাজ করছি, হিংসা দেখাব বেশ করব। তুমি চাও না, দেখো না। খামখা সেমিনার ফলাচ্ছ কেন?

Advertisement

আর ফেমিনিস্টদের তো বলিহারি। স্পর্শকাতরতার ইন্ডাস্ট্রি লাগিয়ে রেখেছে! রোজ ভোরে উঠে ছোঁকছোঁক, কোত্থেকে এট্টু অপমান খুঁটে নেওয়া যায়, ব্যস, লেলিহান লব্‌জ লাউগড়াগড়! এই ন্যাকানৈতিক বিশ্বে একটা মেয়েকে ভাল দেখতে বলে কমপ্লিমেন্ট দেওয়া অবধি যাবে না! তার মানেই নাকি আমি তাকে শুধু রক্তমাংসের সমাহার হিসেবে দেখছি আর তার বুদ্ধি-বোধ-ক্ষমতাকে দুচ্ছাই করছি! আরে, রূপের প্রতি মুগ্ধতা মানুষের এক্কেবারে স্বাভাবিক একটা প্রবৃত্তি। মেয়েরাও রূপের দিকে গোল্লা-হাঁ তাকায়। পুরুষচাউনির চেয়ে কিচ্ছুটি কম নয় সে লোভদৃষ্টি। স্ক্রিনে হৃতিক রোশন থাকলে তারা কি জনি লিভারের কমেডিকৌশলের দিকে অধিক ঝুঁকে পড়ে? তারা কি ভাবী স্বামীর ফ্যান্টাসি বুনলে পুং-টির ব্রেনপিণ্ডের এক পিস থ্রি-ডি নেত্রে ভাসায়? মেয়েরা শুধু মন চায়, আর পুরুষরা শুধু দেহ— এ কী বিচ্ছিরি সরলীকরণ? উভয়েই চায় সঙ্গীর দেহ-মন দুইই ঝিংচ্যাক হোক। আবার এই চাওয়া যে বেশিটা রূপকথার ও কমটা বাস্তবের, তাও প্রায় সকলেই জানে। উভয়েই শর্ট-রানে দেহ, লং-রানে মনকে মূল্য দেয় বেশি। কিন্তু তাতে চোখের আরামটাকে খুন হতে হবে কী দুঃখে?

হ্যাঁ, শুধু রূপের ভিত্তিতে কাউকে ভাল বা মন্দ বলে যাচাই করা অন্যায়, এতে তাকে ‘বস্তু’ হিসেবে দেখা হয়। আবার এতেও সন্দেহ নেই, একটা লোকের কাজকম্ম বা ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে, লোকে তাকে শুধু বাহির-রূপ দিয়েই বিচার করে। উসকোখুসকো দাড়িওলা ঝোলাব্যাগ ছেলেকে দেখে ভাবে আঁতেল ও বাতেলাসর্বস্ব, হাইজিন ও নৈপুণ্য ঝাড়ের দিকে। আবার ঝকঝকে কোট-টাই, সন্ধে ছ’টাতেও গালে নীল যত্নশেভ ছোকরা দেখে ভাবে, দায়িত্ববান। উলটোটাও আছে, আঁতেলটি ধাঁ-চকচকে’টিকে দেখে ভাবে, ধুর, ইংরিজিচাটা, ওপরভাসা! কিন্তু একই সঙ্গে সবাই জানে, এই প্রাথমিক ইম্প্রেশনটা ঝলকের, পরে যদি চেনাজানা ঘটে, পুরো ধারণাটাই বদলে যেতে পারে। রূপে মুগ্ধও হব (বা নিরুৎসাহ) আবার রূপ পেরিয়ে অনেকটাই আছে তাও জানব— এই কম্বো-বোধ নিয়েই মানুষ হাঁটে-চলে। মানুষ তো ফিনফিনে একমাত্রিক কার্টুন নয়, সে জটিল ও বহুস্তর। ইজ্মবাজরা এ কথাটা বুঝতে চায় না, বা বুঝতে গেলে তাদের যতটা শ্রম, এবং ইজ্মটাকেও সাল্‌টে নেওয়ার যে ঝুঁকি, সেগুলোর মুখোমুখি হতে চায় না। আসলে, একবগ্গা কথা ভাবা ও বিশ্বাস করার সাংঘাতিক সুবিধে। এতে গোটা পৃথিবীটাকে সাদা-কালোয় ভাগ করে নিশ্চিন্তে ঢোলা যায়, যে কোনও ঘটনাকে সে কুঠুরিগুলোর একটায় ঠুসে দিতে পারলেই বাকি কাজগুলো পর পর কমন পড়ে যায়। প্রশংসা করতে হবে না নিন্দে, কী গৎ ধরে চিল্লাতে হবে বা পিটিশন জমা দিতে হবে, পুরোটাই রিফ্লেক্স অ্যাকশন, রুটিন। তার ওপর এ পাখি-শেখা ফর্মুলার বাঁয়ে এক পিস ক্রোধের ইঞ্জিন ঘরঘর! যায় কোথা! কিন্তু তা বলে শপিং মল থেকে বেরোবার পথে পুরুষের সম্মোহিত দৃষ্টির আঁচে রূপসি কিছু কম গরবিনি হয় কি? পলিটিকালি কারেক্ট রূপসিও?

Advertisement

আমি কী করেছি? টুইট করেছি, ‘এমএলএ এমন দেখতে হলে বলতেই হবে অচ্ছে দিন এসে গেছে। এই প্রথম পলিটিক্সের প্রেম পড়লাম।’ এখানে কি বলা হয়েছে, মহিলাটির এমএলএ হওয়ার যোগ্যতা নেই? বা, তিনি শুধু রূপ খেলিয়ে এমএলএ হয়েছেন? আরে, গ্রো আপ! এটা একটা নিরীহ রসিকতা! ফাজলামি ও রূপ-প্রশস্তির মিশেল! জানি, পাণ্ডিত্যের মূল প্রজেক্টই হল রস-কে পৃথিবী থেকে রগড়ে মুছে ফেলা, আর অবশ্যই রসিকতাকেও। কারণ রসিকতার মধ্যে একটা আনন্দাভিলাষ আছে, যেটা পণ্ডিতদের চার চক্ষের বিষ! তাঁরা মনে করেন আনন্দ মানেই লঘুতা, আর গোমড়াপনা মানেই সিরিয়াসনেস! কিন্তু ফুরফুরে থাকা যে আমার জন্মগত অধিকার! তুমি ভাই, থুড়ি বোন, আমার বিবৃতিটাকে তোমার গালাগালের সুবিধের জন্যে ভুলভাল ইঙ্গিতে লোড করে দিচ্ছ কেন? রূপ চমৎকার জিনিস, পৃথিবীর সেরা ব্যাপারগুলোর একটা, তাকে ডিফেক্ট বলে রটিয়ো না। আবার, যে লোকটা রূপের স্তুতি করেছে, তাকে ‘নারীত্বের অবমাননাকারী’ লেবেল কোরো না। আমি গুণের অপমান করিনি, রূপকে মান দিয়েছি মাত্র। সে কাণ্ডকে যদি গা-জোয়ারি ধোলাই দাও, তা হবে বীরাপ্পনাতীত ভায়োলেন্স! সেই নিয়ে ছবি করলে আবার বাগড়া দিয়ো না। বেছে বেছে না হয় জঘন্য দেখতে নারীদেরই নেব!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন