সম্পাদকীয় ১

প্রথম ধাপ

তবে প্রাপ্তির আনন্দে আশঙ্কার অন্ধকারগুলি ভোলা যাইবে না। প্রস্তাব তো প্রস্তাবমাত্র, তাহা কী ভাবে রূপায়িত হইবে, আদৌ হইবে কি না, এই সব জরুরি ‘ফলো-আপ’ প্রশ্ন জরুরি-তর হইয়া উঠিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share:

খবর পাইলে জেমস মাইকেল লিংডো পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রীকে আশীর্বাদই করিতেন। অনেক বিলম্বিত, সংকট-কণ্টকিত, তবু যে শেষ পর্যন্ত রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির দীর্ঘ হস্ত হ্রাস করিবার একটি প্রারম্ভিক প্রয়াস শিক্ষামন্ত্রীর মুখে ঘোষিত হইল, তাহা নিশ্চয় সুসংবাদ। কেবল তাহাই নয়, লিংডো কমিশন দশকাধিক কাল আগে যে ধরনের প্রস্তাব দিয়াছিল, তাহার সঙ্গে রাজ্য সরকারের প্রস্তাবিত বিজ্ঞপ্তিটির অনেক সাদৃশ্য— ইহা দেখিয়াও আশার সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। না মানিয়া উপায় নাই, ভারত অধুনা যে গণতন্ত্রের প্রকাশ ও বিকাশ প্রত্যক্ষ করিতেছে, তাহাতে শাসক দলের পক্ষে ছাত্ররাজনীতির সহিত দূরত্ব তৈরি করিবার সিদ্ধান্তটি লওয়া অতিশয় কঠিন। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, ক্ষমতায় আসিয়াই যে কাজ করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেন তাহা শুরু করিতে করিতে এতগুলি বছর অতিক্রান্ত হইয়া গেল। যে শাসক দলের মাথার উপর লাগাতার চাপিয়া থাকে পূর্বতন সরকারের কয়েক দশকব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিপত্তির স্থলে নূতন ক্ষমতাসীন দলের শক্তি-বপনের গুরু দায়িত্ব, তাহার পক্ষে কী ভাবেই বা তড়িঘড়ি ছাত্র-রাজনীতির সংস্কার চালু করা সম্ভব। অবশেষে বপন-রোপণ সন্তোষজনক মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে, তাই সংস্কারের ডাক আসিয়াছে। সদিচ্ছার এই দুর্লভ অবকাশে যদি রাজ্যের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাজনীতির পরিবেশ কিছুটা হটিয়া যায়, শিক্ষার পরিবেশ কিছুটা ফিরিয়া আসে, তাহা বিরাট প্রাপ্তি বলিতে হইবে।

Advertisement

তবে প্রাপ্তির আনন্দে আশঙ্কার অন্ধকারগুলি ভোলা যাইবে না। প্রস্তাব তো প্রস্তাবমাত্র, তাহা কী ভাবে রূপায়িত হইবে, আদৌ হইবে কি না, এই সব জরুরি ‘ফলো-আপ’ প্রশ্ন জরুরি-তর হইয়া উঠিতেছে। বিজ্ঞপ্তিটির মধ্যে না িক সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় ও লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে প্রচলিত মডেলগুলির ছায়া সুস্পষ্ট। এই মডেলের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু ইহাও প্রণিধানযোগ্য যে, এই মডেল ইচ্ছা করিলেই অকার্যকর করিয়া দেওয়া সম্ভব। ৬০ শতাংশ হাজিরা না থাকিলে পড়ুয়া নির্বাচনে দাঁড়াইতে পারিবে না, ইহা অন্যতম বিধান। বিধানটি উত্তম, কিন্তু যুগ যুগ ধরিয়া কলেজগুলিতে হাজিরার হিসাবে যে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মিশাইবার কলকব্জা প্রচলিত, তাহা মাথায় রাখিলে এই বিধান নেহাত কাগুজে মাত্র। শিক্ষকদের বেশি করিয়া ছাত্র সংসদের সহিত জড়াইতে হইবে, ইহা আর একটি বিধান। অনুমান, তাহাতে ছাত্রদের রাজনীতি প্রবণতা ব্যাহত হইবে। অথচ, শিক্ষক যে ‘সুযোগ্য’ অভিভাবক হিসাবে ছাত্রকুলের রাজনীতি প্রবণতা উশকাইতে পারেন, তাঁহার নিজেরও যে কিছু ‘প্রবণতা’ থাকিতে পারে, ইহা ধর্তব্যের মধ্যে থাকে নাই।

থাকা সম্ভবও নহে। কোনও সংস্কারই সর্বতো ভাবে নিশ্ছিদ্র হইতে পারে না, অনাচার ঢুকাইবার ইচ্ছা থাকিলে তাহা সব ক্ষেত্রেই ঢোকানো সম্ভব। ফলত সাম্প্রতিক প্রস্তাবের সমালোচনা অর্থহীন। কিন্তু প্রস্তাবটিকে আশীর্বাদ করিতে করিতেই অভিজ্ঞ লিংডো সাহেব হয়তো মনে করাইয়া দিতেন যে, কেবল খাতায়-কলমে শর্ত লিখিয়া কোথাও পৌঁছানো যায় না, প্রয়োজন দৃঢ় মানসিকতার। প্রশাসনকে অতিমাত্রায় সতর্ক হইতে হইবে, শর্তগুলির একটিও ভঙ্গ হইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাহার চড়া দাম দিতে হইবে, ছাত্রনির্বাচন রাজনীতি-কণ্টকিত হইলে তাহা বাতিল করিতে হইবে, দুরভিসন্ধি-চালিত ছাত্রছাত্রীদের বিধিভঙ্গের দায়ে শাস্তি পাইতে হইবে। সর্বোপরি, সব প্রলোভন ত্যাগ করিয়া শাসক দল যেন তাহার প্রভাব সরাইয়া/কমাইয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি মুক্ত পরিবেশ তৈরি করিতে দেয়। এই শেষ শর্তটি রক্ষাই দুরূহতম, সংস্কার-উৎফুল্ল মন্ত্রীও তাহা জানেন। কিন্তু এই শর্ত রক্ষিত না হইলে গোটা সংস্কারই আসলে প্রহেলিকামাত্র।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন