বিষ যখন মাথায় ওঠে, চিকিৎসা তখন দুরূহ

ফেরার চেষ্টা বৃথা তাই

ভর্তির মরসুমে কলেজগুলিতে ক্ষমতাধর ছাত্র ইউনিয়নের দাদা-দিদিদের অতি সক্রিয়তা কোনও অভিনব ঘটনা নয়।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৮ ০০:৫১
Share:

ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! চাওয়ার সঙ্গে পাওয়া, প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তব বহু ক্ষেত্রেই তো মেলে না। কিন্তু কিছু কিছু চাওয়ার ভিত্তিতে সমাজের কোনও চেনা মলিন ছবি হয়তো কিছুটা হলেও বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আবার সেগুলি ভেস্তে যেতে দেখলে সামনে আসে অনেক প্রশ্ন। গলদ কোথায়? সদিচ্ছায়, না কি প্রয়োগে? সদিচ্ছা যদি থাকে, তা হলেও কী ভাবে, কোন চক্রের কবলে পড়ে তার মৃত্যু হয়? আমরা জানি, এক একটি ক্ষেত্রে সেই ম়ৃত্যুর চেহারা এক এক রকম। এখন যেমন, সব চেয়ে বেশি আলোচনা কলেজে ভর্তির চক্র নিয়ে। আসলে যা ক্ষমতার দুষ্টচক্র। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ‘সদিচ্ছা’-ও যাকে দমন করতে ব্যর্থ।

Advertisement

ভর্তির মরসুমে কলেজগুলিতে ক্ষমতাধর ছাত্র ইউনিয়নের দাদা-দিদিদের অতি সক্রিয়তা কোনও অভিনব ঘটনা নয়। এক সময় সেই সক্রিয়তার মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের শক্তি দেখিয়ে নবাগতদের দলে টানা। ভর্তির সময় তাঁরা প্রধানত টেবিল পেতে বসে ফর্ম ফিল-আপে সহায়তা করতেন এবং টাকা জমার সময় অফিস ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ইউনিয়নের চাঁদার রসিদ কাটতেন। এমনকি, যেখানে শাসক এবং বিরোধী দুই দলের ইউনিয়নই পাল্লা দিত, সেখানে উভয়েই চাঁদার খাতা বাড়িয়ে দিত। কিন্তু দু’চার জনের ভর্তির ব্যাপারে অধ্যক্ষের কাছে উমেদারি করা ছাড়া ‘এতগুলি সিট চাই’ বলে আগাম হুমকি দেওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। ছিল না ভর্তি ‘করানোর’ জন্য জুলুম করে পড়ুয়ার থেকে হাজার হাজার টাকা তোলা আদায়ের বেপরোয়া ছাত্র-রাজনীতি।

বলতে দ্বিধা নেই, এটা এই আমলের আমদানি। মূল রাজনীতির ধারাস্রোতের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তনের হাওয়ায় ছাত্র-রাজনীতিতেও শাসক দলের প্রতিরোধহীন একক আধিপত্য কায়েম হয়ে গিয়েছে। আর তার অনিবার্য পরিণামে জুলুম পেয়ে গিয়েছে অবাধ অধিকার।

Advertisement

সিন্ডিকেট-মাফিয়ারা যেমন তাদের হেফাজতের বাইরে গিয়ে কাউকে একখানা ইটও কিনতে দেয় না, বিভিন্ন কলেজ ইউনিয়নে ছাত্র নামক এক শ্রেণির বাহুবলীও তেমনই পুরো ভর্তি প্রক্রিয়াটিকে নিজেদের হুকুম মতো চালাতে চায়। তালিকায় কার নাম আগে রইল বা পরে, কে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ, কে টেনেটুনে পাশ— এ সব কোনও কিছুই তাদের কাছে বিচার্য নয়। ভর্তি-মাফিয়াদের ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ না দিলে কলেজের খাতায় নাম তোলা এখন কার্যত অসম্ভব। ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ বলতে ওই গুন্ডার দল অকুতোভয়।

পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়েছে, তার কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। যারা ভুক্তভোগী, তাদের অভিজ্ঞতার কাহিনি। কোনও প্রত্যন্ত জায়গা নয়, কলকাতার দু’টি কলেজের কথা বলব। হাঁড়ির একটি ভাত টিপে যেমন সবটুকুর হাল বোঝা যায়, এটাও তেমনই বুঝিয়ে দেবে কী চলছে।

প্রথমটি, সল্টলেক-লাগোয়া মহিষবাথানের বাসিন্দা এক যুবকের। তার মা আয়ার কাজ করেন। প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে ছেলেটি। ভূগোলে অনার্স পড়তে চেয়ে নিয়মমাফিক অনলাইনে ভর্তির ফর্ম জমা করেছিল শিয়ালদহ অঞ্চলের একটি পুরনো কলেজে। নামও উঠেছিল তালিকায়। ২৩ জুন সকাল সাতটায় ছেলেটি কলেজে পৌঁছে গিয়েছিল কাউন্সেলিংয়ের জন্য। তার নিজের কথায়, ‘‘একটা দাদা আমাকে ডেকে বলে, এখানে চান্স পাওয়া মুশকিল। তোমার ডকুমেন্ট দেখি।’’ তার পরে ভর্তির ফর্ম, চালান কপি ইত্যাদি হস্তগত করে সেই ‘দাদা’ বলে যান, ‘‘আমি দেখছি কী করা যায়।’’ অপেক্ষা করেও ‘দাদা’ ফিরছেন না দেখে ছেলেটি নিজেই খোঁজ করে তাঁর কাছে যায়।

এ বার কী হল? ভর্তি-প্রত্যাশী জানাচ্ছে, ‘‘আমি ডকুমেন্ট ফেরত চাইলে সে ঘোরাতে থাকে। শেষে বলে, তিরিশ হাজার টাকা দিতে হবে। পারব না বলায় আমাকে অশ্রাব্য গালাগালি ও খুনের হুমকি দেয় গার্জেনদের সামনে।’’ ওই ‘দাদা’র নামও (এখানে লিখলাম না) জানিয়েছে ছেলেটি। একটি ঘরে ছেলেটিকে আটকে রাখা হয়েছিল। যাতে সে কাউন্সেলিংয়ে যেতে না পারে। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে যখন সে ছাড়া পায়, ওই ‘দাদা’র বাহিনী তখন আরও একটু দাম চড়িয়ে ফরমান দেয়, ‘‘পঞ্চাশ হাজারে রাজি থাকলে যেন ফোন করি।’’ মোবাইল নম্বরও বলে দেয় তারা। অর্থ সহজ। তোলার টাকা হাতে এলে তারা যে কোনও ‘অনিয়ম’কেই নিয়মে বদলে দিতে পারে!

তালিকায় নাম ওঠার পরেও শুধু ছাত্র নামধারী এক দল তোলাবাজ গুন্ডার দাপটে কলেজের দোরগোড়া থেকে ভর্তি না হয়ে ফিরে গিয়েছে মহিষবাথানের ওই যুবক। একই ভাবে ফুলবাগানের একটি কলেজ থেকে ফিরে যেতে হয়েছে বিএ পাস কোর্সে ভর্তি হতে চাওয়া এক ছাত্রীকে। এটি জুলুমের দ্বিতীয় উদাহরণ।

মেয়েটি কন্যাশ্রী-র টাকায় লেখাপড়া করে। অনলাইনে আবেদনের পরে তালিকায় নাম ওঠে এবং সে ভর্তি হতে যায়। লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর ‘কষ্ট’ লাঘব করতে মেয়েটিকে তাঁর অভিভাবক-সহ ভিতরে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে টেবিল-চেয়ার পেতে বসেছিলেন যাঁরা, তাঁরা খুব কমবয়েসি নয়। মেয়েটিকে বলা হয়েছিল, তালিকায় নাম উঠলেও লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্তি হতে সে পারবে না। তাই ওই টেবিলে মার্কশিট জমা রেখে পর দিন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে এলে তবেই তার ভর্তির সাধ পূর্ণ হবে। যত টাকা চাওয়া হয়েছিল, তা দেওয়ার ক্ষমতা ওই পরিবারের নেই। পছন্দের কলেজে ভর্তির ভাবনা শিকেয় তুলে মেয়েটি এখন অন্য কলেজ খুঁজছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে দিন নেতাজি ইন্ডোরে দলের সভায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে সতর্ক করে বলেছেন, ভর্তি নিয়ে তোলাবাজি তিনি বরদাস্ত করবেন না। এমন অভিযোগ যে আসছে, সে কথাও জানাতে রাখঢাক করেননি তিনি। কিন্তু পরিহাস হল, তাঁর হুঁশিয়ারির চব্বিশ ঘণ্টা যেতে না যেতেই একের পর এক ঘটনার খবর আসছে। যাতে প্রমাণ হয়, মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছার বার্তা বা সু-পরামর্শ কার্যত ভস্মে ঘৃতাহুতি! কেউ তা শোনে না।

আসলে শোনানোর মতো পরিস্থিতিই আজ আর নেই। বিষ মাথায় উঠলে তার চিকিৎসা দুরূহ। মাথা কাটা তো আর সম্ভব নয়! ভর্তি নিয়ে অনিয়মের এই প্রবণতা অঙ্কুরে বিনাশ করার কোনও চেষ্টা দলের উঁচুতলা থেকে হয়নি। বরং তেমন চেষ্টায় জল ঢালা হয়েছে। সত্যিই এই ভর্তি-মাফিয়াদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্য থাকলে পুরো ভর্তি প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন করার পথ থেকে দল কখনওই পিছিয়ে আসত না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরে কেন্দ্রীয় অনলাইন প্রথা চালু করার উদ্যোগ করা হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা দফতরের প্রস্তাব ছিল, অনলাইন ভর্তি নিয়ন্ত্রিত হবে সরাসরি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ যে কোনও কলেজে কোনও বিষয়ে কে কত নম্বর পেয়ে ভর্তি হতে পারবে, তার সবই খোলা খাতার মতো চোখের সামনে থাকবে। প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী অনলাইন ভর্তির তালিকায় নাম উঠলে টাকা জমা দেওয়া যাবে অনলাইনেই। ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট কলেজে ক্লাস করতে যাবে। তার আগে কলেজমুখো হতেই হবে না। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ্ধতির সাফল্য পরীক্ষিত হল।

কিন্তু শাসক দলের মাথারাই বলতে শুরু করলেন, এ ভাবে চললে ইউনিয়নের রাশ হাতে থাকবে না। ফলে রাজনীতির কাছে সু-নীতি হেরে গেল। অনলাইন ভর্তি এখন কলেজ ভিত্তিক। সেখানে বুথের সামনে থেকে ভোটার তাড়ানোর মতো কলেজের গেট থেকে ভর্তি হতে যাওয়া পড়ুয়াদের খেদিয়ে দেওয়ার, ভয় দেখানোর এবং তোলা আদায়ের পথ প্রশস্ত। অর্থ এ ভাবেই অনর্থ ঘটাচ্ছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু দশচক্রে ভগবানও ভূত! তাঁর সদিচ্ছা যদিও থাকে, চার পাশের গুপ্ত কুমন্ত্রণায় বার বার তা আচ্ছন্ন হয়। ফিরতে গেলেও তাই ফেরা হয় না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন