সম্প্রীতির পাঠ দেয় রানিগঞ্জের পীর সাহেবের উরস

মধ্যযুগে বাংলার রাজ সিংহাসনে মুসলিম রাজশক্তির প্রতিষ্ঠার পরে প্রাথমিক অস্থিরতা স্তিমিত হয়ে গেলে শুরু হয় ভক্তি ও সুফি আন্দোলন। এই দু’টি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দুই জাতির মধ্যেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। লিখছেন মহম্মদ নাসিমুল গণিমধ্যযুগে বাংলার রাজ সিংহাসনে মুসলিম রাজশক্তির প্রতিষ্ঠার পরে প্রাথমিক অস্থিরতা স্তিমিত হয়ে গেলে শুরু হয় ভক্তি ও সুফি আন্দোলন। এই দু’টি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দুই জাতির মধ্যেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। লিখছেন মহম্মদ নাসিমুল গণি

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০৭
Share:

পীর সাহেবের উরস উপলক্ষে মেলা। রানিগঞ্জে। নিজস্ব চিত্র

বাংলার নানা স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে সুফি ধর্মপ্রচারকদের সমাধি এবং সাধনস্থল। এগুলি আবহমান কাল থেকে হিন্দু, মুসলিম সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে গন্য হয়ে আসছে। সত্যিই ভাবলে অবাক হতে হয় যে, আজকের ভারতে, যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা এবং ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষদের সহাবস্থানের জন্য সরব হতে হচ্ছে, সেখানে কী সুন্দর ভাবে সেই মধ্যযুগ থেকে এই দুই ধর্মাবলম্বীরা পরস্পরকে সম্মান করে বেঁচে ছিলেন। দুই ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থানের চিত্র পাওয়া যায় মধ্যযুগের নানা কাব্যে। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ মধ্যযুগে মনসামঙ্গলের কাহিনিতে স্থান পেয়েছিল ‘হাসান হোসেন পালা’। মালাধর বসু, সনাতন গোস্বামীর মতো কবি ও তাত্ত্বিকরা সে কালের রুকনুদ্দিন বরবক শাহ এবং হোসেন শাহের মতো রাজাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তাঁদের কাব্যে।

Advertisement

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মধ্যযুগের মানুষ এই সম্প্রীতি ও সহনশীল সহাবস্থানের পাঠ পেয়েছিলেন কোথায়? জবাবে অনেকেই বলেন, মধ্যযুগে বাংলার রাজ সিংহাসনে মুসলিম রাজশক্তির প্রতিষ্ঠার পরে প্রাথমিক অস্থিরতা স্তিমিত হয়ে গেলে শুরু হয় ভক্তি ও সুফি আন্দোলন। এই দু’টি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দুই জাতির মধ্যেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। সহনশীল সহাবস্থান এবং ধর্মীয় দর্শনের আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি জন্ম নেয়। এই আত্মীকরণের পিছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সে কালের সুফি সাধকেরা। এক দিকে, চৈতন্যদেব ভালবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলেন হরিদাসের মতো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে। অন্য দিকে, বাংলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আউলিয়া, চিস্তি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সুফি সাধকেরা গ্রামের নিম্নবিত্ত হিন্দু ও মুসলিম সমাজকে দিয়েছিলেন অধ্যাত্ম চেতনার পাঠ। সেই কারণেই বোধ হয় আজও পশ্চিমবঙ্গের বহু স্থানে সুফি সাধকদের সমাধিকে ঘিরে উরস উৎসব, সব ধর্মের মানুষের যোগদানে আক্ষরিক অর্থেই ‘মহামানবের মিলনতীর্থ’ হয়ে ওঠে। তেমনই একটি জনপদ রানিগঞ্জ। যেখানে বছরের পর বছর ধরে একটি উরস উৎসব বাংলা-বিহার-ঝাড়খণ্ডের সব ধর্মের মানুষকে এক মঞ্চে শামিল করছে।

সাধারণ ভাবে ‘রানিগঞ্জ’ বললেই কয়লার অনুষঙ্গ উঠে আসে। কয়লা আবিষ্কার এবং উত্তোলন শুরু হওয়ার সময় থেকেই পশ্চিম বর্ধমানের এই জনপদটি ভারতবর্ষের সব প্রান্ত থেকে আসা মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। আসলে রানিগঞ্জের মজ্জায় সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ক্ষমতাটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার অনেক আগেই। সুফিসাধক মীর ফজলে হক শাহ শামসুদ্দিন ইন্দ্রাবি-র মতো মানুষজনের হাত ধরেই রানিগঞ্জ নিয়েছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পাঠ। আজও যখন পাশের ঝাড়খণ্ড, বিহার থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসেন রানিগঞ্জের পীর সাহেবের উরসে যোগ দিতে তখন বোঝা যায় সুফি সন্ত মীর ফজলে হক শাহ শামসুদ্দিন ইন্দ্রাবির শিক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়নি। আজ থেকে ১৭২ বছর আগে আরবি সন ১২৬৮ হিজরিতে (এখন চলছে ১৪৪০ হিজরি) তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পটনার বিখ্যাত ওলিআল্লাহ খানদানে। পিতা শাহ ফখরুদ্দিন ইন্দ্রাবি ‘বড় হুজুর’ এবং ভাই শাহ কামরুদ্দিন ইন্দ্রাবি ‘ছোট হুজুর’ নামে পরিচিত ছিলেন।

Advertisement

ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, পীরসাহেবের পূর্ব পুরুষেরা কাবুলের মধ্যবর্তী অন্দরাব অঞ্চল থেকে কাশ্মীর আসেন ধর্ম প্রচারের জন্য। তাই এই সিলসিলার আওলিয়া-এ কেরামদদের ‘ইন্দ্রাবি’ বলা হয়। কথিত আছে, শরিয়ত, তরীকত, মারফত ও হাকীকতের বিভিন্ন পর্যায়ের সাধনা উত্তীর্ণ হয়ে এই সিদ্ধপুরুষ রানিগঞ্জ ও তার সন্নিহিত রোনাই গ্রামে অবস্থান করেন। এখানে বসবাসকালে তিনি এলাকাবাসীকে ধর্মোপদেশ দিতেন। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে তাঁকে বহু বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়ে হয়েছিল। তার জেরে তাঁর প্রথম জীবনে এই এলাকায় তিনি তেমন জনপ্রিয়তা পাননি। সেই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে তিনি তাঁর ভালবাসা এবং ভক্ত বৎসলতার মধ্যে দিয়ে এলকাবাসীর মন জয় করতে সক্ষম হন। তাঁর নিজস্ব ভক্তমণ্ডলী তৈরি হয়। ভক্তদের চোখে তিনি ছিলেন ‘সংসার মোহমুক্ত ওলিআল্লাহ’ (আল্লাহ বা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র)। ৬৮ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ভক্ত এবং অনুগামীরা তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে মাজার গড়ে তোলেন। সেই থেকে আজ অবধি ফাল্গুন মাসের ৪ তারিখ তাঁর মৃত্যুদিনে মাজার শরিফে উরস উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। পয়লা ফাল্গুন কবর ধোয়া হয়। এই কবর ধোয়া পানি সংগ্রহ করেন ভক্তেরা। ফাল্গুনের সাত তারিখ পর্যন্ত সন্দল, চাদর, পোশি, ফাতেহখানি, মেহেফিলে সীমা (ধর্মীয় সঙ্গীত অনুষ্ঠান) মিলাদ শরিফ-সহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

উরস উপলক্ষে আজও মাজার শরিফের পাশে মেলা বসে। সপ্তাহখানেক মেলা চলে। এই সময় রানিগঞ্জ যেন নতুন জীবন পায়। এই সময় এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে অতিথিরা আসতে থাকেন। বিহার এবং ঝাড়খণ্ড থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের সমাগমে স্টেশন চত্বর জমজমাট হয়ে ওঠে। পীর সাহেবের মাজারে চাদর চাপাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষজন ভিড় করেন। আজকের যুগে এই মেলার অসাম্প্রদায়িক আবেদন এবং সবার যোগদান নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে শিক্ষণীয়।

মীর ফজলে হক শাহ শামসুদ্দিনের মতো সুফি সাধকদের হাত ধরেই ভারতবর্ষের সংস্কৃতির মূল সুর ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ গড়ে উঠেছিল। সংসারের তথাকথিত বন্ধনকে উপেক্ষা করে এরা যুগের পর যুগ ধরে ভারতবর্ষকে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রক্ষার পাঠ। তাই আজকের যুগে এই সব মেলাগুলিকে আরও বেশি করে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা দরকার। বিপন্ন বর্তমানের বুকে দাঁড়িয়ে আমাদের অতীতই পারে ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সুরের কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিতে।

রানিগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন