বিপর্যয়। সুন্দরবনের সবুজকে কালো করে দিচ্ছে জোয়ারের জলে ভেসে ওঠা তেল।
আজকের কথা নয়। ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনের উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে বন দফতর যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তা দেখে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়েছিলেন। উপগ্রহ থেকে সুন্দরবনের পশ্চিম দিকের (পশ্চিমবঙ্গের দিকটা) যে ছবি রাজ্য বন দফতরের রিমোট সেন্সিং বিভাগ তুলেছিল তাতে দেখা গিয়েছিল: চারিদিকে ঘন বনাঞ্চল, মাঝখানটা ফাঁকা, যেন টাক পড়ে গিয়েছে। রাজ্য বন দফতরের রিমোট সেন্সিং বিভাগের এক অফিসারের কথায়, “১৯৮৯ সাল থেকেই আমরা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক এই পরিবর্তন লক্ষ করে আসছি। বছরের বিভিন্ন সময় আমরা বার বার করে ছবি তুলছি সুন্দরবনের। প্রতি বারই দেখা যাচ্ছে বদ্বীপের মাঝখানের টাকটা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। অথচ সুন্দরবনের পূর্ব দিকে তেমন কোনও পরিবর্তন আমাদের চোখে পড়েনি।”
কেন এমন হচ্ছে? রাজ্য বন দফতরে সু্ন্দরবনের বায়োস্ফিয়ার বিভাগ, রিমোট সেন্সিং বিভাগ, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প, কেন্দ্রীয় সরকারের বন দফতর, সার্ভে বিভাগ একযোগে গবেষণা শুরু করে। উপগ্রহের মাধ্যমে আশপাশে জলাভূমির ছবি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সুন্দরবনের পশ্চিম অংশ দিয়ে যে সব নদী আগে সাগরে মিশত, সেগুলির অধিকাংশ হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নয়তো সেগুলির জল ধারণ ক্ষমতা এতই কমে গিয়েছে যে বদ্বীপের মাটি তাতে তেমন ভিজছে না। বদ্বীপের মাঝখানটায় মিষ্টি জল পৌঁছচ্ছেই না। সমুদ্রের জোয়ারভাটার জন্য নোনা জল ভেজাচ্ছে পুরো বনাঞ্চলই। তাই
ধীরে ধীরে সুন্দরবনের পশ্চিম দিকের জঙ্গলে নুনের ভাগ অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। আর তাতেই সুন্দরী বা সোঁদরি গাছের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। মিষ্টি জলের সরবরাহ না বাড়ালে এই গাছ আর বাঁচানো যাবে না, এমনটাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। যা গোটা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেবে।
এখানে ভূপ্রকৃতির একটা ভূমিকা আছে। সমীক্ষকরা জানাচ্ছেন, “সুন্দরবনের বদ্বীপটা ঠিক কচ্ছপের পিঠের মতো। খাঁড়ির দিকগুলি নিচু। মাঝখানটা উঁচু। নিচু দিকটা সব সময় নোনা জলের সংস্পর্শে থাকায় সেখানে গোলপাতা, হেঁতাল ইত্যাদি গাছের সংখ্যা বেশি। এখানকার জঙ্গল তাই খুব একটা গভীর নয়। জঙ্গলের মাঝখানটা দিনে রাতে ধুইয়ে দিত নদীর মিষ্টি জল। ওই অঞ্চলে মাটিতে নুনের ভাগ তাতে কমত। দ্রুত বাড়ত সোঁদরি গাছ। জঙ্গল আরও ঘন হত।” সর্বশেষ উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, “বিদ্যাধরী নামে যে নদী দিয়ে সুন্দরবনের বনাঞ্চলে আগে মিষ্টি জল আসত সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাতলা নদীর জলের প্রবাহও কমছে। গঙ্গার প্রবাহ খুব ধীরে ধীরে বহু দিন ধরে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। এখন তার প্রভাব পড়েছে সুন্দবনের উপরে।” অন্য সমস্যাও রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চিংড়ি চাষের জন্য আটকানো হচ্ছে বৃষ্টির জল। নদীগুলি দিয়ে তাই মিষ্টি জল সুন্দরবনের জঙ্গলে পৌঁছতেই পারছে না।
সুন্দরবনের শতকরা ২৫ ভাগ পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বাকি ৭৫ ভাগ রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ গবেষণা যথেষ্ট না হওয়ায় ভারতের বন দফতরের কর্তাদের বাংলাদেশের বাদাবন সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিল না। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও সুন্দরবনের সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি ডব্লিউডব্লিউএফ, বাংলাদেশের ওয়াটার ফর পিপল এবং এ দেশের এনভায়রনমেন্ট গভর্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশন-এর সহযোগিতায় বিশ্বব্যাঙ্ক ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, গবেষক ও পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের জন্য একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সুন্দরবনের অন্দরে ঘুরে, সুন্দরবন বাঁচানোর জন্য দুই দেশ যৌথ ভাবে কী করতে পারে তার উপায় উদ্ভাবনের জন্যই ওই তিন দিনের কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। পর্যবেক্ষক দলটিকে নিয়ে জাহাজ এম ভি পরমহংস তিন দিন ধরে ভেসে বেড়িয়েছে সুন্দরবনের এক নদী থেকে আর এক নদীতে। আর জাহাজের কনফারেন্স রুমে চলেছে আলোচনা। মাঝে মাঝে কোনও দ্বীপে নামা, ঘুরে দেখা সংকটের চেহারা-চরিত্র।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা জানালেন, ও পারের সুন্দরবনে গত কয়েক বছরে সুন্দরী গাছ কমেছে শতকরা ৭৬ ভাগ, গেঁয়ো গাছ কমেছে শতকরা ৮০ ভাগ। কেন? সমস্যাটা এ-দিককার মতোই। বালেশ্বর, পাসুর ছাড়া আর যে সব নদী সুন্দরবনে মিষ্টি জল সরবরাহ করত সেগুলির উত্সমুখ আটকে গিয়েছে, কিংবা অন্য কোনও কারণে তারা মিষ্টি জলের সরবরাহ পাচ্ছে না। এদের মধ্যে কারও সরাসরি যোগাযোগ িছল মেঘনার সঙ্গে, কারও বা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। সত্তরের দশকে ফরাক্কা ব্যারেজ তৈরি হওয়ায় সুখা মরসুমে গঙ্গা দিয়ে আসা জলের প্রবাহ অনেকটাই কমে আসছে। তাই সুন্দরবনে যথেষ্ট মিষ্টি জল নিয়ে যেতে পারছে না বালেশ্বর, পাসুররা। পাশাপাশি, বাংলাদেশের এক প্রতিনিধি বললেন, “এক দিকে নোয়াখালির কাগজ কলের জন্য গেঁয়ো গাছ কাটা হয়েছে নির্বিচারে। আবার সুন্দরবনের খাঁড়ি পথে অত্যধিক মোটরবোট চলাচলের ফলে জলের সঙ্গে মিশছে্ পোড়া তেল, মোবিল। জোয়ারের জল তেল মোবিলকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে উপরে। গোলপাতার জঙ্গল বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং কিংবা উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় গেলেই বোঝা যাবে সুন্দরনের এই হাল কেন। মাতলা নদী উজানে ক্রমাগত বুজতে বুজতে চলেছে। ক্রমেই নদী সরে যাচ্ছে দূরে। স্টেশন থেকে নদীর দূরত্ব এক কিলোমিটার হয়ে গিয়েছে। ক্যানিং বন্দরের অস্তিত্বই প্রায় নেই। আর হাড়োয়ায় বিদ্যাধরীতে ময়লা আর নোনা জল ঢুকিয়ে চলছে চিংড়ি চাষ। যেখানে সেখানে নদী আটকে চিংড়ি ঘেরি হয়েছে। নদীবক্ষের জমি চলে গিয়েছে যাচ্ছে ইটভাটার মালিক আর চিংড়ির ঘেরি মালিকদের হাতে। অনেকটা একই ছবি চোখে পড়বে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার গাবুড়া, বুড়িগোয়ালিনি, মুন্সিগঞ্জ কিংবা খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ-এও।
কেন কড়া আইন প্রণয়ন করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা এখনও হল না? তার কোনও জবাব ছিল না ভারত-বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের কাছে। এক পরিবেশ বিজ্ঞানীর মন্তব্য, “আসলে সমস্যার মূল উত্স খোঁজার বদলে আমরা অন্য সমস্যার খোঁজ করি। সেখানেই মনোনিবেশ করি। কথার খই ফোটে। কাজের কাজ কিছু হয় না।’’
পরিবেশবাদীরা বলছেন, সুন্দরবনে জলে-জঙ্গলে কোন কোন প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে অবিলম্বে সমীক্ষা শুরু হওয়া প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন চিংড়ির পোনা ধরার কাজেও। কিন্তু বিকল্প কোনও কাজই যে দিতে পারছে না রাজ্য সরকার। তাই পুরো বিষয়টা থেকে যাচ্ছে পরিকল্পনার স্তরেই। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যাঁরা চিংড়ির পোনা ধরেন তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করছেন, চিংড়ির পোনার সঙ্গে জালে উঠে আসছে ভাঙন, পারশে, তপসের পোনা। সেগুলিকে মেরে ফেলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মারা পড়ছে নানা ধরনের জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদ। একই ভাবে নদীর বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে মাছ ধরার গ্রিল নেট। ওই জাল নদীর নীচ থেকে ছেঁচে তুলছে যাবতীয় কিছু।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় সুন্দরবন সংক্রান্ত একটি আলোচনাচক্রে তত্কালীন কেন্দ্রীয় সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল এস কে পান্ডে বলেছিলেন, “হিমাচল প্রদেশে জঙ্গলের ভারসাম্য রক্ষায় অন্যতম সমস্যা হল ছাগল। ছাগল ঘাসের মূল সুদ্ধ খেয়ে নেয়। ফলে নতুন ঘাস আর জন্মাতে পারে না। তখন আমরা শিক্ষানবীশ। বলেছিলাম, ‘ছাগল তাড়ালে বা মারলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়।’ আমাদের শিক্ষক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘প্রতিটি ছাগলেরই ভোট আছে। তাই ছাগল তাড়ানো মানেই ভোট নষ্ট।’ ৪০ বছরের চাকরি জীবনের পরেও কথাটা মনে আছে। আমার মনে হয় সুন্দরবনের বাঘ, ঘড়িয়াল আর সুন্দরী গাছদের ভোট থাকলে তাদের বোধ হয় এ ভাবে মরতে হত না।”