নবতেজ জোহর বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে ইতিমধ্যেই ঢের আলোচনা হয়ে গিয়েছে। মামলার নামটা অবশ্য যথেষ্ট চেনা না-ই লাগতে পারে। এটা সেই মামলা, যার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সমকামিতাকে ‘অপরাধ’-এর তকমামুক্ত করেছেন। ২০১৩ সালের সুরেশ কুমার কৌশল বনাম নাজ় ফাউন্ডেশন মামলায় সুপ্রিম কোর্টেরই দুই বিচারপতির বেঞ্চ ৩৭৭ ধারাকে সম্পূর্ণ সংবিধানসিদ্ধ হিসেবে রায় দিয়েছিল। বর্তমান রায়ে আদালত সেই অবস্থানটিকে নাকচ করল।
রায়টিতে আদালত সমকামিতাকে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ’-এর আওতা থেকে বার করে এনেছে। গত কিছু দিন ধরে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রচুর, কিন্তু আইনের দিক থেকে দেখলে, সেই আলোচনা মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘুরেছে— যৌন পছন্দের নিরিখে সংখ্যালঘু বলেই যে সমকাম অপরাধ হতে পারে না, আদালত সেই কথা জোর দিয়ে জানিয়েছে। সাধারণ্যের নৈতিকতার বোধ আর সাংবিধানিক নৈতিকতার বোধ যে আলাদা, এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, এই রায় আরও বেশ কিছু কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রেক্ষিতে রায়টিকে আমরা কী ভাবে দেখব, এই লেখায় সে বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
নবতেজ জোহর মামলার রায়কে বুঝতে গেলে পরিপ্রেক্ষিতের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। ২০১৩ সালে কৌশল মামলার পর থেকেই সমকামী আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমে বেড়েছে। অন্য দিকে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ন্যায়ের প্রতি আদালতের সংবেদনশীলতা স্পষ্ট হয়েছিল ২০১৪ সালের ন্যাশনাল লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলার রায়ে। সেই রায়ে আদালত তৃতীয় লিঙ্গকে পুরুষ এবং নারীর মতোই আর একটি লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয় এবং জানায়, সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারে এই লিঙ্গের মানুষদেরও সমান অধিকার আছে। নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার অধিকারকেও স্বীকার করে নেয় আদালত। এর পরের ধাপ ২০১৭ সালের পুত্তাস্বামী রায়। সেই রায়ে দেশের শীর্ষ আদালতের নয় বিচারপতির বেঞ্চ গোপনীয়তার অধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, পুত্তাস্বামী মামলার বেঞ্চে থাকা দুই সদস্য, বিচারপতি চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি নরিম্যান নবতেজ জোহর মামলার বেঞ্চেও ছিলেন। মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরের, যার মধ্যে চয়নের অধিকার ও যৌনতার অধিকারও পড়ে— গোপনীয়তার অধিকারকে যে কোনও ভাবেই খর্ব করা যায় না, পুত্তাস্বামী মামলার রায়ে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে দিক থেকে দেখলে, নবতেজ জোহর মামলার রায়টি প্রত্যাশিতই ছিল।
আর একটা কথা খেয়াল করা ভাল। ভারত সরকার কিন্তু এই মামলার আবেদনের বিরোধিতা করেনি, বরং সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর প্রশ্নে শীর্ষ আদালতের ওপর নিজেদের সম্পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেছিল। এই অবস্থানের দু’ধরনের তাৎপর্য আছে। সরকার এক রকম বুঝেই গিয়েছিল আদালতের রায় কোন দিকে যাবে। আর রাজনৈতিক ভাবেও নির্বাচনের বছরে নিজেদের উদার ভাবমূর্তি তৈরি করার এই সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়তে চায়নি। রায় প্রকাশের পরও বিজেপির প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সংযত। বিশেষত ২০১৩ সালের রায়ের পর বিজেপির যে প্রতিক্রিয়া গোটা দেশ দেখেছিল, সেই তুলনায় আজকের সংযম তাৎপর্যপূর্ণ। পাশাপাশি, এই রায়ে একাধিক সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের মতে, রায়টি তাঁদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ওপর আক্রমণবিশেষ। সে কথা মনে রাখলে বিজেপির প্রতিক্রিয়ার তাৎপর্য আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়।
কোনও একটি আইন সংবিধানস্বীকৃত সমান অধিকারের পরিপন্থী, এই মর্মে কোনও মামলা হলে দীর্ঘ দিন ধরে একটা নিয়ম চালু আছে— সরকার (যারা স্বভাবতই আইনটির পক্ষে থাকবে) দেখাতে চাইবে বিবাদী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আইনটি ‘রিজ়নেব্ল ক্লাসিফিকেশন’ করছে, অর্থাৎ দু’টি অসম গোষ্ঠীকে অসম ভাবে দেখছে। এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে দুটো শর্ত পূরণ করতে হয়। এক, বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যে ফারাক করার মতো যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে, তা দেখাতে হয়; দুই, এই ফারাক করার ন্যায্য প্রয়োজনীয়তা আছে, তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজটা সরকারের পক্ষে খুব কঠিন নয়। বিশেষত, কোনও আইনকে যত ক্ষণ প্রশ্নাতীত ভাবে সংবিধানবিরুদ্ধ প্রমাণ না করা যাচ্ছে, আদালত তত ক্ষণ তাকে আইনসিদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করবে। কাজেই, কোনও আইনকে সংবিধানবিরুদ্ধ প্রমাণ করার কাজটা সহজ নয়।
গত শতকের সত্তরের দশক থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আর একটি শর্ত। দেখা হয়, কোনও সিদ্ধান্ত খেয়ালখুশি-মাফিক প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না। কিন্তু, বহু দিন ধরেই এই শর্তটি শুধু প্রশাসনিক কাজের সাংবিধানিক ন্যায্যতা বিচারের জন্যই ব্যবহৃত হয়, কোনও আইনের সাংবিধানিকতা বিচার করার ক্ষেত্রে নয়। ব্যতিক্রম আছে বটে, কিন্তু খুব বেশি নয়। অতি সম্প্রতি, তাৎক্ষণিক তিন তালাক মামলার রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি নরিম্যান ও ললিত দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানান যে আইনের ক্ষেত্রেও এই মাপকাঠিটি সমান প্রযোজ্য। যদি মনে হয় কোনও আইনের মধ্যে এই ‘ম্যানিফেস্ট আর্বিট্রারিনেস’ বা প্রকাশ্য যুক্তিহীন খামখেয়াল রয়েছে, তবে সেই আইনটিকে বাতিল করা যেতে পারে। নবতেজ জোহর মামলাতেও এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। বিচারপতিরা সহমত হয়েছেন যে কোনও একটি বিশেষ গোত্রের যৌনতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে চিহ্নিত করে দেওয়ার মধ্যে যুক্তিহীনতা রয়েছে।
এই মামলায় মাননীয় বিচারপতিরা আরও দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন, যার সাংবিধানিক তাৎপর্য প্রবল। প্রথমত, বিচারপতি নরিম্যান বলেছেন যে ভারতীয় সংবিধান রচনার আগে থেকে যে আইনগুলি রয়েছে, যেমন ভারতীয় দণ্ডবিধি, অতঃপর বিনা বিচারে ধরে নেওয়া যাবে না যে সেই আইনগুলি সংবিধানসিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, এই মামলার রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি চন্দ্রচূড় সুপ্রিম কোর্টেরই অন্য একটি রায়ের (এয়ার ইন্ডিয়া বনাম নার্গেশ মির্জা) দার্শনিক ও সাংবিধানিক অসঙ্গতির কথা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন। সেই রায়ে আদালত জানিয়েছিল, একই গোত্রের কাজ হওয়া সত্ত্বেও এয়ার হোস্টেস এবং এয়ার ফ্লাইট পার্সার্স-দের চাকরির শর্ত পৃথক হতে কোনও বাধা নেই। প্রথম কাজটি করেন মহিলারা, দ্বিতীয়টি পুরুষরা। আদালত এই দুই গোত্রের কর্মীকে আলাদা বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছিল কারণ তাদের নিয়োগের প্রক্রিয়া আলাদা, চাকরির পরিস্থিতিও— অতএব, বৈষম্যমূলক আচরণ হচ্ছে কি না, তার এক সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে আদালত এই ছাড়পত্রটি দিয়েছিল। আরও অনেক বেশি সমদর্শী ও উদারবাদী অবস্থান থেকে বিচারপতি চন্দ্রচূড় এই রায়টিকে প্রশ্ন করেছেন। লিঙ্গ-সাম্যের প্রশ্নে এই অবস্থানের তাৎপর্য কতখানি বিপুল, অদূর ভবিষ্যতেই তা বোঝা যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
নবতেজ জোহর মামলায় আদালত কোনও ব্যক্তিবিশেষের যৌন পছন্দকে তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অঙ্গ হিসেবে, এবং আত্মসম্মান ও স্বাধিকারের প্রকাশ হিসেবে দেখেছে। আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছে যে সমকামিতা কোনও রকম মানসিক অসুস্থতা নয়। বিচারপতি নরিম্যান তাঁদের অবস্থানের সপক্ষে ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে কারও যৌন পছন্দের নিরিখে বৈষম্য না করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি চন্দ্রচূড় ও মলহোত্র উল্লেখ করেছেন যে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে দেগে দেওয়ার অর্থ ব্যক্তিবিশেষের স্বাস্থ্যের অধিকার লঙ্ঘন করা। কারণ, সমকামী সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের যৌন পরিচয় গোপন করার তাগিদেই চিকিৎসকের কাছে আসতে ইতস্তত করেন এবং সেই কারণেই তাঁরা যৌন সংক্রামক অসুখেও অনেক বেশি আক্রান্ত হন ও ভোগেন।
আদালতের এই রায়ে সমকামী মানুষদের সামাজিক জীবনের ছবিটা আমূল বদলে যাবে, সেই আশা বোধ হয় কেউ করেন না। কিন্তু, পরিবর্তনের পথে এ রায় মস্ত পদক্ষেপ, তাতে সংশয় নেই।
(ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস-এ আইনবিদ্যার শিক্ষক)