জলের ন্যায় কঠিন

রাজস্থানে ইস্তেহারে জলের ব্যবস্থা করিবার জন্য অর্থবরাদ্দের প্রতিশ্রুতি আছে। ভারতীয় রাজনীতির চিরাচরিত ‘বিজলি-পানি-সড়ক’-এর বয়ান যত দূর পৌঁছায়, অন্যান্য রাজ্যেও জলের প্রসঙ্গ ততখানিই আসিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৩২
Share:

জলের দাবিতে প্রতিবাদ মুম্বাইতে।—ছবি পিটিআই।

রাজস্থানই হউক বা তেলঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ অথবা ছত্তীসগঢ়, বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে বারে বারেই ফিরিয়া আসিয়াছে জলের কথা। জলের সঙ্কটের কথা। কিন্তু, যতখানি তীব্র ভাবে প্রশ্নটি উঠা স্বাভাবিক ছিল, ততখানি কি উঠিয়াছে? শুধু এই রাজ্যগুলিতেই নহে, গোটা দেশেই জল এখন অন্যতম বৃহৎ সমস্যা। নীতি আয়োগের সমীক্ষা জানাইতেছে, প্রায় ৬০ কোটি ভারতীয় এখন তীব্র হইতে অতি তীব্র জলসঙ্কটের শিকার, শুধু জলের অভাবেই প্রতি বৎসর দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা যাইতেছেন। ২০৩০ সালে দেশে জলের চাহিদা যত হইবে, জোগান থাকিবে তাহার অর্ধেক। অর্থাৎ, যদি কোনও একটিমাত্র প্রশ্নকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া বিধেয় হয়, তবে সেটি কোন প্রশ্ন, তাহা বোঝা জলের ন্যায় সহজ। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে বোঝা যাইবে, রাজনীতির মঞ্চে সত্যই জল বেশি দূর গড়ায় নাই। রাজস্থানে ইস্তেহারে জলের ব্যবস্থা করিবার জন্য অর্থবরাদ্দের প্রতিশ্রুতি আছে। ভারতীয় রাজনীতির চিরাচরিত ‘বিজলি-পানি-সড়ক’-এর বয়ান যত দূর পৌঁছায়, অন্যান্য রাজ্যেও জলের প্রসঙ্গ ততখানিই আসিয়াছে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষ প্রতি দিন যে সমস্যায় জর্জরিত হন, রাজনীতির বয়ানে তাহার তুলনায় হিন্দুত্ববাদের গুরুত্ব ঢের বেশি— প্রবক্তাদের কাছে, বিরোধীদের কাছেও। কেন, তাহার উত্তর সন্ধান করা জরুরি।

Advertisement

প্রথমত, জলের সমস্যা এখনও অবধি মূলত মহিলাদের সমস্যা। পানীয় জল, অথবা গৃহস্থালির জলের ব্যবস্থা করিবার দায়িত্ব তাঁহাদের উপরই ন্যস্ত। ফলে, কলস মাথায় মেয়েরা মাইলের পর মাইল হাঁটিয়া যান, কিন্তু তাঁহাদের অন্যান্য সমস্যার ন্যায় জলের প্রশ্নটিও রাজনীতির মূলধারায় ঠাঁই পায় না। এই সঙ্কটে মহিলাদের উৎপাদনশীলতা বিপুল ভাবে হ্রাস পায়, তাঁহাদের ভাল থাকিবার মাপও কমে। জিডিপি-র অঙ্কে যদি গৃহস্থালির উৎপাদনশীলতা মাপা যাইত, তাহা হইলে এই সঙ্কটের ছবিটি স্পষ্টতর হইত। বস্তুত, জাতীয় আয়ের মাপকাঠিতে যেটুকু ধরা পড়ে— অর্থাৎ, অর্থনীতি যাহাকে ‘উৎপাদনশীল কাজ’ হিসাবে গণ্য করে, সেখানে মেয়েদের অবদান— তাহাতেই পানীয় জলের অভাবে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি দেখা সম্ভব। স্বচ্ছ, পরিস্রুত জলের অভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতির ফলও সেই অঙ্কেই দেখা যায়। কিন্তু, তাহাতে রাজনীতির চিঁড়া ভিজে না। অতএব, ভোটের লাইনে দাঁড়াইয়া থাকা প্রবীণা অথবা জলের খোঁজে বহু ক্রোশ পথ হাঁটিয়া আসা গৃহবধূর অসন্তোষ, ক্ষোভ, কিছুই রাজনৈতিক বয়ান হইয়া উঠিতে পারে না।

তাহার তুলনায় ঢের বেশি রাজনৈতিক প্রশ্ন কৃষির জল। যে জলের অভাবে রাজ্যের পর রাজ্যে খেতের পর খেত শুষ্ক পড়িয়া থাকে। কিন্তু, এই ক্ষেত্রেও ভারতীয় রাজনীতির চলন বিশিষ্ট। ২০১৮ সাল কৃষক বিক্ষোভের বৎসর হিসাবেই থাকিয়া যাইবে। কিন্তু, সেই বিক্ষোভেও মূল দাবি ছিল সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির, কৃষিঋণ মকুবের, এমনকী ফসলবিমারও। সেচের প্রশ্নটি কৃষি রাজনীতির দায়রার বাহিরেই থাকে ইদানীং। তাহার কারণ একাধিক। বৃহৎ সেচের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি, এবং ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার হ্রাসের প্রয়োজনের কথাকে রাজনৈতিক ভাবে কখনও তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই। বিদ্যুতে বিপুল ভর্তুকি দিয়া বরং গভীর নলকূপের মাধ্যমে জল তুলিয়া চাষ করাতেই প্রণোদনা দিয়াছে রাজনীতি। অন্য দিকে, কৃষকের ক্ষোভ মিটাইবার সহজ রাস্তা হিসাবে বাছিয়া লইয়াছে ঋণ মকুবের ন্যায় তাৎক্ষণিক পন্থাকে। তাহাতে সাময়িক ভাবে কৃষকের রাগ পড়িয়াছে, কৃষির বৃহত্তম সমস্যাটির সমাধান হয় নাই। জলের প্রশ্ন এখনও রাজনীতির মূলধারায় নাই। তাহাতে রাজনীতির কতখানি লাভ, সেই প্রশ্ন অবান্তর। ভারতের ক্ষতি বিপুল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন