এই নতুন দেশটাতে তাঁর তবে আর জায়গা হবে না

দুর্ভাবনা কমছে কই

এই যে আমাদের দেশ, যেখানে বাবার নাম না জানলেও চলে, পরিচয়পত্রের দরকার হয় না কোনও দিন, অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও দেশহারা নবাগতের দিক থেকে জলমাটিআকাশ মুখ ঘুরিয়ে নেয় না— সেখানে যদি খবর আসে, নাগরিক পঞ্জি তৈরি হচ্ছে, ১৯৭১ সালের আগেকার পরিচয়পত্র না থাকলে সেই পঞ্জিতে নাম ওঠানো যাবে না? যদি কেউ না শোনে যে পরিচয়পত্র নেই-ই মোটে? যদি না মানে যে কাকে পরিচয়পত্র বলে, সেটাই এঁরা জানেন না? 

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

উদ্বেগ: নাগরিক পঞ্জিতে নাম আছে কি না, জানার জন্য এনআরসি সেবা কেন্দ্রতে প্রতীক্ষারত মানুষ। মরিগাঁও, অসম। ৩১ জুলাই। পিটিআই

আবাল্যকাল নদিয়াবাসী গৃহ-পরিচারিকা বলছিলেন বাবার নামটা তাঁর ঠিক জানা নেই, কিংবা মনে নেই, তাঁর শিশুবেলায় এ দেশে আসার পর অনেক বছর আগে গত হয়েছেন বাবা, কবে তা-ও বলা অসম্ভব। কোনও কাগজ? কী জানি, পড়তে তো পারেন না, তাই জানেনও না। হাসি-মুখে বিস্ময় আর ধরে না— কিন্তু এ সব দিয়ে কী হবে? কোনও তো অসুবিধা হচ্ছে না, জীবন তো চলছে যেমন চলার। শুনতে শুনতে আমি কেবল শুকনো মুখে সন্তর্পণে হিসেব করি, বয়স এখন যা, তাতে মনে হয় ১৯৭১ সালের আগেই এসেছেন এ দেশে। কিন্তু কাগজ যে নেই, কী হবে তার?

Advertisement

এই যে আমাদের দেশ, যেখানে বাবার নাম না জানলেও চলে, পরিচয়পত্রের দরকার হয় না কোনও দিন, অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও দেশহারা নবাগতের দিক থেকে জলমাটিআকাশ মুখ ঘুরিয়ে নেয় না— সেখানে যদি খবর আসে, নাগরিক পঞ্জি তৈরি হচ্ছে, ১৯৭১ সালের আগেকার পরিচয়পত্র না থাকলে সেই পঞ্জিতে নাম ওঠানো যাবে না? যদি কেউ না শোনে যে পরিচয়পত্র নেই-ই মোটে? যদি না মানে যে কাকে পরিচয়পত্র বলে, সেটাই এঁরা জানেন না?

অসমের যে চল্লিশ লক্ষ মানুষের কথা এখন কাগজের শিরোনামে, তাঁদের অনেকের নাম এই ভাবেই বাদ পড়েছে। তাঁদের কয়েক জনের কাহিনি কাগজে পড়তে গিয়ে শিউরে উঠলাম। অসম না হয়ে যদি পশ্চিমবঙ্গ হত, তবে তো আমাদের পরিচারিকার নামও বাদ পড়ত! কেউ কি শুনত কিছু?

Advertisement

এই শোনানো-বোঝানোর দরজাটা একেবারে বন্ধ করে দিয়েই অসমে নাগরিক পঞ্জির কাজ সম্পাদিত হয়েছে। সেই জন্যেই ১৩ বছরের ছেলে রোজ় আহমদের নাম তালিকায় থাকেনি, তার বাবা-মায়ের নাম থাকলেও। ২৫ বছরের মাসুমা বেগমের নাম থাকেনি, কিন্তু তাঁর ভাইবোনের নাম আছে। মইনুল হক যতই দাবি করুন, জন্মের কোনও ‘কাগজ’ না থাকলেও তাঁর বাবা অসমে জন্মেছেন, যতই বলুন তাঁর মায়ের বাবার পরিচয়পত্র ছিল না বলেই মা পরিচয়হীন, কেউ শোনেনি তাঁর কথা— তিনি এখন অ-নাগরিক! যে চল্লিশ লক্ষ মানুষ অ-নাগরিক বলে ধার্য হয়েছেন, তার মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ ‘ডি-ভোটার’, অর্থাৎ ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহভাজন ভোটার। তাঁরা একে একে নিজেদের কাগজপত্র নিয়ে এসে আবার নথিভুক্ত করানোর চেষ্টা করতে পারেন। সফল হলে তাঁদের নাম উঠবে ‘চূড়ান্ত’ তালিকায়— আগামী জানুয়ারি মাসে সেই তালিকা প্রকাশিত হবে। আর যদি কাগজপত্র সত্যিই না থাকে, তবে কী হবে বলা যাচ্ছে না। এক বিজেপি নেতা বলেছেন, তাঁদের তখন গুলি করে মারা হবে। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা বলেছেন, তাঁদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্ট যদিও এখনকার মতো আশ্বাস দিয়েছে যে তালিকার ভিত্তিতে কোনও প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা যাবে না, আর নির্বাচন কমিশন যদিও বলেছে যে তালিকায় নাম না থাকলে ভোটের অধিকার হরণ করা হবে না— সে সবই কিন্তু বর্তমান তালিকার কথা, জানুয়ারির চূড়ান্ত তালিকার কথা নয়। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, চূড়ান্ত তালিকার পর দেশহীন পরিচয়হীন আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন এই বিরাট পরিমাণ অ-নাগরিক, যাঁদের সকলেই বেআইনি হয়ে থেকে যাওয়ার জন্যই এ দেশে আসেননি— কেউ কেউ এ দেশে এসে আইনি হতে চেয়েও হতে পারেননি, কেউ কেউ নিজেদের আইনি মতে নাগরিক জেনেই বসবাস করে এখন কাগজপত্র দেখাতে না পেরে রাতারাতি অ-নাগরিকে পরিণত!

অমিত শাহরা যখন এমন একটা কাজ করার জন্য বুক চাপড়ে নিজেদের ‘হিম্মত’-এর কথা বলেন, কিংবা অরুণ জেটলিরা যখন দেশের সার্বভৌমতার বিপদ ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে তর্ক জোড়েন, নাগরিক পঞ্জির সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন— তখন তাই একটি গোড়ার প্রশ্ন ওঠে। ঠিক করে বলুন তো তাঁরা— এত যে গোলমেলে পদ্ধতিতে এবং অস্বাভাবিক দ্রুততায় কাজটি করা হল, তা কি দেশের স্বার্থে, না তাঁদের রাজনীতির স্বার্থে? অসমের মতো প্রদেশে, যেখানে অভিবাসী আগমন ও আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাস, সেখানে বেআইনি অভিবাসীদের আলাদা করার প্রয়োজন না-হয় ছিলই, কিন্তু ‘আলাদা করা’র অর্থই কি এমন একটা অমানবিক তালিকা তৈরি? ভারত তো মায়ানমার বা সিরিয়া নয়, সে তো ভাবতেও পারত অন্য কোনও সমাধান? রাজনীতিটাকে পাশে সরিয়ে রাখলে হয়তো সেটা পাওয়াও যেত। সাধারণ নিরীহ মানুষ তা হলে ভয়ে এমন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তেন না। রাজীব গাঁধী অসম চুক্তি করে ঠিক করেছিলেন না ভুল করেছিলেন, বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু তিনি এত তাড়া দেখাননি, এই দিয়েই ভোটতরণি তীরে ভিড়ানোর পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। বেআইনি অভিবাসী হলেই ‘অপরাধী’ গোত্রে ফেলাটা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না।

মজার ব্যাপার, দেশের ‘সার্বভৌমতা’র কথা ভেবে যখন অরুণ জেটলি, অমিত শাহ ও তাঁদের সমর্থক-সমাজের রাতে ঘুম হচ্ছে না, ‘মানবিকতা’ শব্দটা শুনলেই কিন্তু তাঁরা তেলেবেগুনে চটে যাচ্ছেন। ‘মানবিক অধিকার’ বললেই ধরে নিচ্ছেন, ‘নাগরিক অধিকার’-এর বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে! কিছু মানবাধিকার গোষ্ঠী এনআরসি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শুনে অমিত শাহের সপাট মন্তব্য, তিনি নাগরিকদের মানবাধিকারটাই আগে দেখতে চান, বাইরে থেকে আসা মানুষের চাপে যে সব নাগরিকের কাজের সুযোগ হাপিশ হয়ে যাচ্ছে, তাদের কথাই তাঁর মন জুড়ে বিরাজ করে থাকে! তাই, নাগরিকের অধিকার ভাবার সঙ্গেই যে অভিবাসীদের মানবিক অধিকারটাও ভাবা যায়, অন্তত তালিকা তৈরির সময়ে একটু মানবিক সংবেদন দেখানো যায়, এ সব শুনতেও তাঁরা রাজি নন।

এই অনিচ্ছা ও অনাগ্রহের কারণটা লুকিয়ে আছে তাঁদের উদ্দেশ্যের মধ্যেই। সার্বভৌমতা, নাগরিক অধিকার, দেশপ্রেম ইত্যাদি ভাঙিয়ে তাঁরা রাজনীতি করছেন। আর একটু পরিষ্কার করে বলি? দেশের সার্বভৌমতা ও নাগরিকের অধিকার রক্ষার নামে তাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছেন! অসমের বেআইনি অভিবাসী মাত্রেই যে হেতু মুসলমান, তাই ওই জায়গাটাই তাঁরা বেছে নিয়েছেন দেশপ্রেম দেখানোর জন্য, ২০১৯ সালের ভোটের দিকে তাকিয়ে এই সময়টাই তাঁরা বেছে নিয়েছেন দেশপ্রেমাক্রান্ত নাগরিক পঞ্জির জন্য। অন্যদের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির জন্য দোষারোপ করতে করতে তাঁরা নীরবে নিশ্চিন্তে নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের ভরণপোষণ করছেন, তাই তাঁদের সার্বভৌমতার দুর্ভাবনার মধ্যে মানবিকতার ভাবনার এক চুলও ঠাঁই হয় না। জায়গা পায় কেবল হিসেব— জানুয়ারি মাসে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ, তার দু’এক মাস বাদেই ভোট। সোজা রাস্তা, নাক-বরাবর!

এই কারণেই উদ্বাস্তু ও বেআইনি অভিবাসীর মধ্যে একটা পার্থক্যও তাঁদের জিইয়ে রাখতে হয়। অমিত শাহ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন: ‘অন্য দেশ’ (অর্থাৎ বাংলাদেশ) থেকে আত্মসম্মান বা ধর্মের কারণে কেউ (অর্থাৎ বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা হিন্দু) চলে আসতে চাইলে তাঁরা উদ্বাস্তু। আর চাকরি বা জীবিকার সন্ধানে যাঁরা চলে আসেন, তাঁরা বেআইনি অভিবাসী। অমিত শাহের যুক্তিতে একটি না-বলা বাণীও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে: যদি কোনও হিন্দু ও পার থেকে জীবিকার সন্ধানে এসে থাকেন, ধর্মের কারণেই তিনি ‘উদ্বাস্তু’। আর যদি কোনও মুসলিম ও পার থেকে জীবিকার সন্ধানে এসে থাকেন, তা হলে ধর্মের কারণেই তিনি ‘বেআইনি অভিবাসী’। আশ্চর্য, অমিত শাহের সমীকরণ মেনে চললে, এই হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য কিন্তু নাগরিক অধিকার বিপন্ন হয় না, নাগরিকের কাজকর্মের ক্ষেত্রেও চাপ পড়ে না! এই সব সরবতা ও নীরবতা থেকে বেরিয়ে আসে আর একটি সমীকরণ: অমিত শাহদের মতে, দেশের সার্বভৌমতার বিপন্নতা কেবল মুসলিমদের জন্যই। নাগরিক পঞ্জির প্রয়োজন মোটেই দেশের জন্য নয়, দেশ থেকে মুসলমান-বিতাড়নের জন্য!

—ওপরে যে পরিচারিকার কথা বলছিলাম, তাঁর তবে বিপদ নেই তত। কাগজপত্র থাক না থাক, তিনি তো হিন্দু, পঞ্জি শুরু হলে তিনি হবেন উদ্বাস্তু!

তবে আমার দুর্ভাবনা কমছে কই। আর এক পরিচারিকাও যে আছেন বাড়িতে, তাঁর পরিচয়পত্র নথি-দলিলের অবস্থাও যে একই রকম খারাপ। তিনি মুসলিম। অমিত শাহদের তৈরি এই নতুন দেশটাতে তাঁর তবে আর জায়গা হবে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন