বন্দুক নয়, হাতে বই তুলেছে গালিব, আমরা সে খবর রাখি?

২০১৩-র ৯ ফেব্রুয়ারি ফাঁসিতে ঝোলানো হয় আফজল গুরুকে। তার পর থেকেই গালিবের ধ্যানজ্ঞান হয় পড়াশোনা। কিন্তু গালিবের খবর কে রাখে, তার মা আর আত্মীয়-পরিজন ছাড়া?

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৬
Share:

চিন্তা: অশান্ত উপত্যকা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্মের এটাই নিয়তি? ডাল লেক, শ্রীনগর, ৬ অক্টোবর ২০০৮। ছবি: গেটি ইমেজেস

জেলবন্দি বাবার কাছে গেলেই সেই বাবা ছেলেকে ভাল করে পড়াশোনা করতে বলতেন। বলতেন, পড়াশোনা শেষ করে তাকে ডাক্তার হতেই হবে। ছেলেকে দেখলেই তিহাড় জেলে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা বাবার যেন আর কোনও কথা থাকত না। ১৩ ডিসেম্বর ২০০১ ভারতের সংসদ ভবনে আক্রমণ চালানোর দায়ে গালিব আফজল গুরুর বাবার ফাঁসির আদেশ হয়।
২০১৩-র ৯ ফেব্রুয়ারি ফাঁসিতে ঝোলানো হয় আফজল গুরুকে। তার পর থেকেই গালিবের ধ্যানজ্ঞান হয় পড়াশোনা। কিন্তু গালিবের খবর কে রাখে, তার মা আর আত্মীয়-পরিজন ছাড়া?

Advertisement

নজরমিনারের আড়ালেও কত কী যে ঘটে চলে! অশান্ত উপত্যকার আনাচকানাচে বুলেটের শব্দ, দুনিয়ার বর্ণ-গন্ধ-রূপ কেড়ে নেওয়া পেলেট গান-এর ছর্‌রা আর আগুনে পরিস্থিতির বাইরেও কোথায় যেন ভেসে আসে আহির ভৈরব!

খবরটা সে-ভাবে সর্বভারতীয় স্তরে আলোড়ন ফেলেনি, ফেলার কথাও নয়। কয়েক দিন আগেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, আফজল গুরুর ছেলে গালিব বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ৮৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেছে। এটাই প্রথম নয়, এর আগে দশ ক্লাসের পরীক্ষাতেও ৯৫ শতাংশেরও বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছিল সে।

Advertisement

বোর্ডের পরীক্ষায় তো আরও অনেকেই পাশ করে! জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর স্টেট বোর্ড অব স্কুল এডুকেশন-এর পরীক্ষায় আরও অনেক ছেলেমেয়েই তো ভাল ফল করেছে। কিন্তু গালিব তো এক ‘সন্ত্রাসবাদী’র ছেলে। তার বাবাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত, তা সেই আদেশ নিয়ে যত চর্চাই হোক, যত প্রশ্নই উঠুক না কেন। যার বাবাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়, যার দিকে বৃহত্তর সমাজ আঙুল তুলে বলে, ওই দেখো, ওই যে ছেলেটা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, ও আফজল গুরুর ছেলে, তার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কী রকম থাকে? সে পড়াশোনায় মন দিতে পারে? সমাজ-শাসক-রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর নজরদারির মধ্যেই তো তাকে দিনযাপন করতে হয়? তারই বয়সি আরও পাঁচটা ছেলেমেয়ে যখন খেলে, পড়াশোনা করে, আড্ডা দেয়, তখন সে কী করে? সে কি মনে মনে ভাবে, তার বাবা কি সত্যিই সন্ত্রাসবাদী?

কী বলে গালিব তার মা তবসসুমকে? সে কি বলে, মা, ভেবো না, দেখো, আমি ঠিক এক দিন ডাক্তার হব?

আমরা জানি না। অত জানার বা ভাবার সময় কি আমাদের আছে? আমরা ‘মূল ভূখণ্ড’-র মূলধারার মানুষ। যে-ভাবে আরও পাঁচটা বিষয়কে দেখি, ঠিক সে-ভাবেই আফজল গুরুর ছেলের ভাল ফল করাটাকে দেখব, বলব, কোথাকার কাশ্মীর, আফজল একটা জঙ্গি, কাজকম্ম নেই, তার ছেলের খোঁজ নিচ্ছে! আসলে এই লোকগুলোই দেশদ্রোহী!

গালিবের কথা আপাতত থাক। আমরা এক কিশোরীর কথা বলি। সে-ও কাশ্মীরের মেয়ে। নাম ইনশা মুস্তাক। সে-ও এ বার ক্লাস টেনের বোর্ডের পরীক্ষায় পাশ করল। গালিব বা অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রধান তফাত, ইনশা দৃষ্টিহীন। দক্ষিণ কাশ্মীরের সোপিয়ান জেলার সেডো গ্রামে তার বাড়ি। দিনটা ছিল ২০১৬-র ১১ জুলাই। তার তিন দিন আগে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যু হয়েছে। গোটা কাশ্মীর বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। গন্ডগোলের আওয়াজ পেয়ে ইনশা রান্নাঘরের জানলা খুলে মুখ বাড়িয়ে দেখতে যায়, কী হচ্ছে। পেলেট গান তখনই তার লক্ষ্য স্থির করে নেয়। অসংখ্য ছর্‌রা তার মুখে, চোখে ও শরীরে ঢুকে যায়। বেশ কয়েকটি মুখগহ্বরেও প্রবেশ করে।

এর পরে সেই একই কাহিনি। টানা চোদ্দো মাস লাগাতার চিকিৎসা, শ্রীনগর, নয়াদিল্লি ও মুম্বইয়ের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ছ’বারের অস্ত্রোপচারেও হাল ফেরেনি ইনশার। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সে যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার বাঁ চোখে শীর্ণকায়া আলোর রেখা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর আর ডান চোখ পুরো অন্ধকার। কার্যত সে সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, কারণ বাঁ চোখের ওই আলোর রেখা ইনশা মুস্তাকের ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগবে না।

ইনশার প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক আর পদার্থবিজ্ঞান। স্কুল থেকে ফিরেই হোমওয়ার্ক সেরে তবে সে বন্ধু আর তুতো বোনদের সঙ্গে খেলতে যেত। ১১ জুলাইয়ের আগের আর পরের জীবনের মধ্যে তার অনন্ত পার্থক্য, তবু হার মানেনি ১৬ বছরের সেই কিশোরী। বোর্ডের পরীক্ষায় নিজে লিখতে না পারলেও সে মুখে উত্তর বলে যায়। এক জন সাহায্যকারী তার সেই উত্তর লিখে দেয়। বই পড়তে পারত না ইনশা। তার গৃহশিক্ষক তাকে বই পড়ে শোনাতেন আর সে স্মৃতিতে তা ধরে রাখার চেষ্টা করত। পরে সেই ভাষ্য রেকর্ড করে রেখে বার বার শুনত সে।

ইনশার বাবা মুস্তাক আহমেদ লোন সরকারি মোটর গ্যারাজ দফতরে কাজ করেন। বড় হয়ে কী হতে চায় ইনশা? গালিবের মতো তারও স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। ছর্‌রা বন্দুক সেই স্বপ্নকে হত্যা করেছে, কিন্তু ইনশাকে দমাতে পারেনি। সে বলে, এখন হয়তো সে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। কিন্তু তার একটাই কথা, ‘যারা আমার এই দশা করেছে তাদের শাস্তি চাই।’ এত কম বয়সেও সে বুঝে গিয়েছে, রাষ্ট্রের এতে কিছু আসে যায় না। এই ব্যবস্থার উপরে তার কোনও ভরসাও নেই।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘লুজিং সাইট ইন কাশ্মীর: দি ইমপ্যাক্ট অব পেলেট-ফায়ারিং শটগানস’ শীর্ষক ১০৯ পাতার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তার প্রচ্ছদে ছর্‌রা-লাঞ্ছিত ইনশা মুস্তাকের মুখের ছবি। ওই রিপোর্টে ছররা বন্দুকের শিকার ৮৮ জনের কথা উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৩১ জনের দু’চোখেই আঘাত রয়েছে, আহতদের মধ্যে ১৪ জন মহিলাও আছেন, যাঁরা বাড়ির মধ্যেই ছিলেন এবং কোনও আন্দোলনেই শামিল হননি।

আর এক সদ্য তরুণ নভিদ ওয়ানি। এ-বার বোর্ড পরিচালিত বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেছে। তার দাদা কে? বুরহান ওয়ানি! গত বছর বুরহানের বোনও বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করে। ২০১৬-র ৮ জুলাই বুরহানের মৃত্যুর পরে উত্তাল উপত্যকায় ঘনঘোর পরিস্থিতির মধ্যেও তার ভাইবোনেরা তাদের পড়াশোনাটা চালিয়ে গেছে।

এই পড়াশোনাটাই হয়তো চালাতে পারত ফারহান ওয়ানি। ১৫ বছরের এই কিশোরের বাড়ি দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায়। স্কুলশিক্ষক গুলাম মহম্মদ ওয়ানির ছেলে একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফিজিক্সের টিউশন নিতে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল গত বছরের ১৪ জুন। আর ফেরেনি। পুলিশ জানিয়েছিল, ফারহান হিজবুল মুজাহিদিনে যোগ দিয়েছে। এর পর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের যত সংঘর্ষের খবর আসত, প্রার্থনায় বসতেন তার মা গওহর জান। কিন্তু সে প্রার্থনা শোনে কে? গত ৯ জানুয়ারি খবর আসে, বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে গওহরের সন্তানের।

কিন্তু উপত্যকার বাইরে যাঁরা পড়াশোনাটা চালাতে গিয়েছেন? শুক্রবারেই হরিয়ানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কাশ্মীরি ছাত্রকে বেধড়ক মারধর করে হেনস্তা করে একদল ‘দেশপ্রেমী’। ওই দু’জন প্রার্থনা সেরে ফিরছিলেন। হেনস্তা কেন? কারণ, কাশ্মীরি মানেই তো জঙ্গি! তারা ‘এখানে’ কী করছে?

ফারহান নেই, কিন্তু আরও অনেক গালিব, অজস্র ইনশা, নভিদ ওয়ানিরা হয়তো লুকিয়ে আছে সন্ত্রাসবিদীর্ণ উপত্যকার আনাচকানাচে। পাহাড়ের কোলের দেওদার আর চিনারের অরণ্য ছুঁয়ে আসা বাতাস তাদের কথা শোনায় হয়তো, কিন্তু প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত, রক্তাক্ত উপত্যকার বাতাসের সে ফিসফিসানিই বা শোনে কে?

উপত্যকার প্রকৃত শক্তি এই তরুণতরুণীরাই, নিরাপত্তা বাহিনী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি নয়।

গালিব আফজল গুরু যদি কোনও দিন ডাক্তার হন, ইনশা মুস্তাক যদি ইঞ্জিনিয়ার হন, নভিদ ওয়ানি যদি সুপ্রতিষ্ঠিত হন, উপত্যকার পুনর্গঠনে যদি শামিল হন তাঁরা, তা হলে হেসে উঠবে ঝিলম, সিন্ধু আর লিডারের বহতা স্রোত!

বিবেক-বোধহীন রাষ্ট্রশক্তি আর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাধ্য কি সেই স্রোত আটকায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন