প্রশ্নের বারুদ

কেহ বলিতেছেন এই সমাজ মানুষকে একাকী ও চূড়ান্ত বিষণ্ণ করিয়া তুলিতেছে, তাহারা মরিয়া যাইবার পূর্বে অন্য কিছু মানুষকে মারিয়া নিজেদের হতাশা উদ্‌গিরণ করিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

আমেরিকায় কয়েক মাস অন্তর কোনও কোনও লোক বিদ্যালয়ে গুলি চালাইয়া নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের মারিতেছে, তাহার প্রতিষেধক হিসাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শিক্ষকদের বন্দুক বহিয়া বেড়াইবার পরামর্শ দিতেছেন। শুনিয়া কেহ বলিতেছেন, শিক্ষকরা এই বার সৈনিকও হইলেন? কেহ বলিতেছেন এই সমাজ মানুষকে একাকী ও চূড়ান্ত বিষণ্ণ করিয়া তুলিতেছে, তাহারা মরিয়া যাইবার পূর্বে অন্য কিছু মানুষকে মারিয়া নিজেদের হতাশা উদ্‌গিরণ করিতেছে, যে সমাজ তাহাকে নিঃসঙ্গ করিয়াছে সে এই হিংস্রতার দায় এড়াইতে পারে না। কেহ বলিতেছে, এত মানুষ বন্দুক নিকটে রাখিতে পারিলে, তাহার হতাশা বা তিক্ততা উহার নল দিয়া নিঃসৃত হইতে চাহিতেই পারে, যদি বন্দুক এমন সহজলভ্য না হইত, ইহার সম্ভাবনাই প্রায় থাকিত না। ছাত্রছাত্রীরা বলিতেছে, বন্দুক নির্মাতাদের নিকট হইতে এমন অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ মার্কিন রাজনৈতিক নেতারা লইয়া থাকেন, তাঁহাদের পক্ষে বন্দুককে বর্জনীয় ঘোষণা করা স্বার্থবিরোধী, ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ বলিয়া বন্দুক রাখিবার ‘মৌলিক’ অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া সুবিধাজনক। কেহ বলিতেই পারেন, কতিপয় মানুষ সমাজ-অনিষ্টকর কথা প্রচার করিতেছে বলিয়া যেমন বাকস্বাধীনতার অধিকার হরণ করা চলে না, তেমনই কিছু মানুষ বন্দুকের অপব্যবহার করিলেই বন্দুক রাখিবার বিপক্ষে হইহই তুলিয়া দেওয়া চলে না। এত মতামতের স্রোতে ও কোলাহলে কিছুতেই বুঝা যাইতেছে না, কেমন করিয়া এক কিশোরের লক্ষ্য হইতে পারে, বিদ্যালয়ে গিয়া কয়েক জন নিরস্ত্র নিরীহ কিশোর-কিশোরীকে মারিয়া, তাহার পর নিজে মরিয়া যাওয়া। ইহা কি ধর্ষকাম, ইহা কি প্রতিশোধ, ইহা কি প্রকৃতপক্ষে মনোযোগ আকর্ষণের মরিয়া প্রয়াস?

Advertisement

ভারতীয়দের মধ্যে বন্দুক রাখিবার অভ্যাস প্রচলিত নহে। কিন্তু তাহা বলিয়া মানুষকে মারা হইবে না, তাহা তো হইতে পারে না। কেরলে এক ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে গণপ্রহার করিয়া হত্যা করা হইল, অনেকে সেই হত্যায় অংশ লইল। সর্বাধিক লক্ষণীয়, প্রহার চলাকালীন অনেকেই অসহায় শিকারটির সহিত নিজস্বী তুলিয়া লইল। অর্থাৎ, একটি মানুষকে বাঁধিয়া অনেকে মিলিয়া হত্যা করাকে তাহারা চিত্তাকর্ষক একটি ঘটনা বলিয়া ভাবিয়াছে। নিহত মানুষটি জনজাতির সদস্য, দীর্ঘ দিন মানসিক ভাবে অসুস্থ। অরণ্যের গুহায় থাকিতেন, মাঝে মাঝে খাদ্যের সন্ধানে বাহির হইয়া আসিতেন। অভিযোগ, তিনি একটি মুদির দোকান হইতে চাল চুরির চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহাকে জেরা করিবার সময়ই লোকের বুঝা উচিত ছিল যে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। কিন্তু তাহা বুঝিলেও, বা না বুঝিলেও, সকলে মিলিয়া মারিতে মারিতে খুন করিবার আরামটি কেনই বা কেহ ছাড়িবে? এই মানুষগুলি, যাহারা মারিয়াছে, যাহারা হত্যাকারী, এবং যাহারা মারে নাই কেবল নিজস্বী তুলিয়াছে, অর্থাৎ সম্মুখে একটি হত্যা হইতেছে দেখিয়াও আপত্তি করিবার কোনও প্রয়োজন বোধ করে নাই, কেবল এই উৎসবটিকে উদ্‌যাপন করিবার প্রয়োজন বোধ করিয়াছে, তাহারা সমাজে স্বাভাবিক বলিয়াই পরিচিত। এই সমাজে আমেরিকার ন্যায় একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা নাই বলিয়াই আমরা দাবি করি। এইখানে হিংস্রতাকে সরকার বা বন্দুক সংস্থা হইতে উৎসাহও দেওয়া হয় না। তবে এমন অমানবিক ও চূড়ান্ত হিংস্র ঘটনা এইখানে ঘটিল কী করিয়া? আমেরিকায় এক জন উন্মাদ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, এইখানে সমষ্টি সেই কাজ করে। তাহা হইলে অধিক বিকৃত সমাজ কোনটি হইল?

তাহার অপেক্ষা বড় প্রশ্ন, কেন সমগ্র বিশ্বে এই পরিমাণ হিংসা বাড়িয়া যাইতেছে এবং তাহার প্রতি সাধারণ মানুষ এমন উদাসীন থাকিবার অভ্যাসই বা কেমন করিয়া রপ্ত করিতেছে? কোন মানসিকতার বশে ধর্ষিতাকে বাঁচাইতে না যাইয়া ধর্ষণের ছবি মোবাইলে তুলিয়া লওয়া যায়? কোনও দেশে বোমা পড়িলে এবং সহস্র নিরীহ লোক মারা যাইলে তাহা লইয়া অন্য দেশে আন্দোলন করিবার কথা না ভাবাই স্বাভাবিক হইয়া পড়ে? কেন দেশে দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থা উদ্বাহু সমর্থন লাভ করে? অত্যন্ত জটিল প্রশ্নগুলির উত্তর দিবার দায় কাহার? তাত্ত্বিকদের, না সাধারণ মানুষের? বলা কঠিন। কিন্তু উত্তর খুঁজিবার প্রক্রিয়াটি চালু হওয়া প্রয়োজন। তাহা না হইলে, অস্ত্রটি আগ্নেয় হউক বা না হউক, পরিস্থিতি ক্রম-অগ্নিস্রাবী হইয়া উঠিবে। প্রশ্ন ও মতামতের বারুদই হিংস্র মারণপন্থার প্রতিস্পর্ধী হইয়া উঠিতে পারে।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

কানাডার জাতীয় সংগীতকে ‘লিঙ্গনিরপেক্ষ’ করে তোলা হল, যে লাইনে ছিল ‘তোমার সকল পুত্রের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলো’, সেখানে হল ‘আমাদের সকলের মধ্যে...’। এ নিয়ে আন্দোলন বহু দিনের, বারো বার বিল পাশ করাবার চেষ্টা হয়েছে, এত দিনে আইনি স্বাক্ষর পড়ল। বদল মাত্র দুটি শব্দের, কিন্তু এক-সমুদ্র মনোভঙ্গির। এ বার দেখা যাক, কোন ভারতীয় ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’-কে লোফালুফি করে, ‘অমৃতস্য সন্তানাঃ’য় পরিণত করে ইতিহাস গড়েন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন