প্রতীকী ছবি।
করোনা ঋতুতে যে ক্ষেত্রগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভয়ঙ্কর প্রশাসনিক দৌর্বল্য প্রকট হইল, তাহার মধ্যে রহিল— উচ্চশিক্ষা-সংক্রান্ত নীতি। বাস্তবিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আজ অতিমারির কারণে যে বিরাট অনিশ্চয়তা ও অসহায়তার মুখে দাঁড়াইয়া, তাহা যেন আরও কিছুটা বাড়িয়া গিয়াছে সরকারি হস্তক্ষেপে। অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উপর্যুপরি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সমস্যা সমাধানের বদলে সমস্যা গভীরতর করিতেই যেন কর্তারা ব্যস্ত। এই বিষম চিত্র পরিষ্কার হইল কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ঘোষিত শেষ সিদ্ধান্তটি হইতে, যাহা এত দিন পর জানাইতেছে যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বর্ষ ও চূড়ান্ত সিমেস্টারের পরীক্ষা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাধ্যতামূলক। স্বাভাবিক ভাবেই, প্রশ্ন অনেক। প্রথমত, ঘোষিত তারিখের মধ্যে পরীক্ষা লইতেই হইবে, এই কথা বলিবার একটিই অর্থ— এখনকার পরিস্থিতির তুলনায় অগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস অন্তত কিছুটা সহনীয়তর হইবে, এই প্রত্যাশা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রক ও কেন্দ্রীয় কমিশনের কর্তাদের জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করে, প্রত্যাশার ভিত্তিটি ঠিক কী। যে পরীক্ষা জুন বা জুলাই মাসে লওয়া যায় নাই, আগামী দুই মাসে দেশের প্রতিটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাহা লইতেই হইবে, এমন ভরসা তাঁহারা করিতেছেন কী যুক্তিতে। কোভিড-১৯’এর গতিপ্রকৃতি এখনও অবধি যেমন, তাহাতে আগামী দুই মাস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাইবে; এমন তো ভাবা মুশকিল। বিশেষত ভারতের মতো দেশে, যেখানে এই মুহূর্তে প্রতি দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আগের দিনের রেকর্ডকে ভাঙিতেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, পরীক্ষা ‘বাধ্যতামূলক’-ই বা কোন যুক্তিতে? গত নির্দেশিকায় বলা হইয়াছিল, পরীক্ষার বদলে ৮০-২০ হিসাবে মূল্যায়নের কথা। তদনুযায়ী রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সহিত একত্র বসিয়া কিছু সিদ্ধান্ত লইয়াছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের তাহাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাইয়া দিয়াছিল। এখন আবার কাঁচিয়া গণ্ডূষ? বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণই বা কী, এবং ছাত্রছাত্রীদের এই বিভ্রান্তিতে ফেলিবার দরকারই বা কী। আরও একটি কথা। এই ছাত্রছাত্রীরা হয় চাকরিতে যোগ দিবে, নয়তো উচ্চশিক্ষা শুরু করিবে। দ্বিতীয় দলের অনেকেই বাহিরের বিশ্বে পা বাড়াইবে। সেই সকল প্রক্রিয়া শুরু হইয়া গিয়াছে। এমতাবস্থায় সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা এবং আরও পরে তাহার ফলাফল: তাহাদের অসুবিধায় ফেলিবার জন্য এমন নীতি যথেষ্ট নহে কি?
এই বার আসিতে হয় শেষ প্রশ্নে। যে পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি গৃহীত হইতেছে, তাহার মধ্যে অন্যায় ও অবাঞ্ছিত কেন্দ্রীকরণের চিহ্ন একেবারে স্পষ্ট। কেন্দ্রের উদ্দেশে প্রেরিত পত্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা সচিব ঠিকই বলিয়াছেন, ইহা স্পষ্টত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। রাজ্যগুলির সহিত আলোচনা না করিয়া, তাহাদের মতামত না লইয়া উচ্চশিক্ষার্থীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার ভারতের সংবিধান কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয় নাই। কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য নহে, পঞ্জাব, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রও কিন্তু স্থির করিয়াছিল, এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা হইবে না। এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার আছে কি না, রাজ্য ও তাহাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কিছু প্রশাসনিক স্বাধীনতা দেওয়া উচিত কি না— ইহা একটি বিতর্কিত বিষয়। তদুপরি, মন্ত্রকও সমানে নাক গলাইয়া কেন্দ্রীকরণের প্রবণতাটিকে যেন এখন চূড়ান্তে লইয়া যাইতে ব্যগ্র। তাই সিদ্ধান্তের পুনর্বিচার করিতে রাজ্য সরকারের আর্জিটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। দেশের অগণিত উচ্চশিক্ষার্থীর বিভ্রম ও সঙ্কট দূর করিতে এই আর্জি মানা হইবে, এমন আশা রহিল।