একটি বিপন্ন প্রজাতি

১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনিক পরিকাঠামোর মূল ভিত্তি। গোড়ায় এই প্রশাসনিক কাঠামোটির নাম ছিল ইম্পিরিয়াল সিভিল সার্ভিস।

Advertisement

অতনু পুরকায়স্থ

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৭ ১৩:০৮
Share:

বাঙালি: প্রথম এবং শেষ ভারতীয় আইসিএস অফিসার: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাঁ দিকে) এবং নির্মল মুখোপাধ্যায়

সম্প্রতি, ১ জুন, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন গেল। ভারতের সিভিল সার্ভিসের জীবনপঞ্জিতে এটি একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ, সত্যেন্দ্রনাথই প্রথম ভারতীয়, যিনি (১৮৬৩ সালে) ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, ১৯৮০ সালে নির্মলকুমার মুখোপাধ্যায় ক্যাবিনেট সেক্রেটারির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের নিযুক্ত শেষ আইসিএস অফিসার। অর্থাৎ, প্রথম এবং শেষ ভারতীয় আইসিএস অফিসার, দু’জনেই ছিলেন বাঙালি।

Advertisement

১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনিক পরিকাঠামোর মূল ভিত্তি। গোড়ায় এই প্রশাসনিক কাঠামোটির নাম ছিল ইম্পিরিয়াল সিভিল সার্ভিস। মেকলে কমিটির (১৮৫৪) সুপারিশ অনুসারে ব্রিটিশরাই কাডারভিত্তিক সিভিল সার্ভিস চালু করে। নিয়ম করা হয়, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার নিয়োগ কেবলমাত্র মেধার ভিত্তিতেই হবে, কোনও সুপারিশের ভিত্তিতে প্রার্থীকে নিয়োগ করা হবে না। মেধাভিত্তিক এই সিভিল সার্ভিসে ভর করেই ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক ভিত গড়ে ওঠে।

১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পরে ভারত সরকার সিভিল সার্ভিসের ‘ইস্পাত কাঠামো’টি ধরে রাখে। তাকে প্রধানত তিনটি শাখায় ভাগ করা হয়। এক, অল ইন্ডিয়া সার্ভিসেস (এআইএস)। এই শাখায় নিযুক্ত কর্মীরা কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারের অধীনেই কাজ করেন। দুই, সেন্ট্রাল সার্ভিসেস (সিসিএস)। এই শাখার কর্মীরা কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেই কাজ করেন। তিন, স্টেট সিভিল সার্ভিসেস (এসসিএস)। এই শাখার কর্মীরা রাজ্য সরকারের অধীনে কাজ করেন। আইএএস অফিসাররা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

Advertisement

লক্ষণীয়, আইসিএসের প্রথম ও শেষ ভারতীয় অফিসার, দু’জনেই ছিলেন বাঙালি। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই পেশাকে সমাজে প্রতিষ্ঠার একটা অনন্য মাপকাঠি হিসেবেই দেখতেন। তখনকার বাংলার নাম-করা এবং প্রতিষ্ঠিত পরিবারের ছেলেরা অনেকেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসতেন। সুভাষচন্দ্র বসু চতুর্থ হয়েছিলেন কিন্তু কাজে যোগ দেননি। অরবিন্দ ঘোষ ইচ্ছে করে ঘোড়ায় চড়ায় পিছিয়ে পড়েন, যাতে তাঁকে এই পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৮৬৯ সালে চার জন ভারতীয় আইএএস পরীক্ষায় সফল হন: সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, বিহারীলাল গুপ্ত এবং শ্রীপদ বাবাজি ঠাকুর। রমেশচন্দ্র সে বার তৃতীয় হন। এই তালিকাই বলে দেয়, বাঙালির অবস্থান কোথায় ছিল। ১৯৪৮ সালে দেশে ২৪২ জন আইসিএস অফিসারের মধ্যে ৪২ জন ছিলেন বাঙালি। এমনকী দেশভাগের বিপর্যয়ও বাঙালিকে এই পেশায় নিযুক্ত হওয়া থেকে বিরত করতে পারেনি। ১৯৪৮ সালে প্রথম আইএএস পরীক্ষায় সফল ৩০ জন অফিসারের মধ্যে ৭ জন ছিলেন বাঙালি, পরের দু’বছর— ৩২ জনের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা যথাক্রমে ৬ ও ৫।

কিন্তু এখন? বাঙালির মধ্যে এই পেশায় যোগদানের না আছে সেই উদ্যম, না আছে সংকল্প। বরং অনীহাই প্রকট। আসলে এই পেশাকে নিজের করে নেওয়ার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা, তাগিদ এবং মূল্যবোধের প্রয়োজন, তার বেশির ভাগটাই আসে মা-বাবা, পরিবার সন্তানকে কেমন করে মানুষ করছেন, তার ওপর। আর তার সঙ্গে সঙ্গে, যাঁরা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা বৃহত্তর সমাজে এই পেশা সম্পর্কে ভাল কোনও ধারণা সৃষ্টি করতে পারছেন কি না, তারও একটা বড় প্রভাব থাকে।

এই পেশা থেকে বাঙালির বিযুক্ত হওয়ার পিছনে সামাজিক ইতিহাসের বড় ভূমিকা আছে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং, বন‌্ধ, ঘেরাও, সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থা। সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির আঁচ গিয়ে পড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর। সেগুলিই হয়ে ওঠে আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। শিক্ষকরা সময় মতো সিলেবাস শেষ করতে পারতেন না, ঠিক সময় পরীক্ষা হত না। এই পর্বের পরে রাজনৈতিক স্থিতি ফিরলেও শিক্ষার গুণমান নিয়ে সমস্যা থেকেই গেল। যে সব ছাত্র স্কুল পাশ করে বেরোতে থাকল, তাদের পড়াশোনার ভিত পোক্ত হল না। ফলে কলেজ ও স্কুলে প্রকৃত শিক্ষা উপেক্ষিত হতে থাকল। তারই ফলভোগ চলছে এখন।

ইতিমধ্যে ১৯৮২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে সরকার ইংরেজি পড়া তুলে দিল। এতে কেবলমাত্র বাঙালি ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শেখা থেকে বিরত থাকল তা-ই নয়, তাদের আত্মবিশ্বাস আঘাত খেল, উচ্চশিক্ষার জগতে তারা অন্যান্য রাজ্যের থেকে পিছিয়ে পড়ল। ২৫ বছর পরে প্রাথমিকে ইংরেজি না-পড়ানোর এই সিদ্ধান্ত বদলানো হলেও তত দিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এ রাজ্যের ছেলে-মেয়েদের সিভিল সার্ভিস-সহ জাতীয় স্তরের যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মানসিক জোর, যোগ্যতা এবং সামর্থ্যের একটা স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।

কেবল তা-ই নয়, সিভিল সার্ভিসের চাকরি নিয়ে বাঙালি তরুণদের মধ্যে তথা সমাজে যে গর্ব ছিল, রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নেতাদের আচরণের জন্য তা ভেঙে গিয়েছে। তৎকালীন সরকারের কাছে রাজ্যের উন্নয়নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল দলের স্বার্থ। ফলে, প্রশাসনে যাঁরা ছিলেন তাঁরা যে ছক-ভাঙা চিন্তাভাবনা দিয়ে রাজ্যের উন্নতি করবেন, তার কোনও সুযোগ ছিল না। যে সব প্রশাসনিক কর্তা শাসক দল বা তাদের অনুগামী ইউনিয়নের কথা মানতে গররাজি হতেন, তাঁদের নানা ভাবে নাজেহাল করাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা অফিসারদের ভাল কাজ করার উদ্যোগ ও মনোবল ভেঙে দেয়। এবং তার প্রতিফলন ঘটে তাঁদের পরিবারে, পরিচিতদের মধ্যে, বৃহত্তর সমাজে। সব দেখেশুনে বাঙালি সমাজের একটা বিরাট শিক্ষিত অংশের মানুষজন সিভিল সার্ভিসকে আর ভাল কেরিয়ার হিসেবে গণ্য করলেন না।

এ ছাড়াও, সাধারণ ভাবে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, প্রশাসনের মধ্যে দুর্নীতির প্রকোপ আছে। এমন একটা দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোর মধ্যে কাজ করার ব্যাপারে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা অনীহা দেখা দেয়। এখানে বলা দরকার, ভারতীয় সংবিধান, আইন এবং নিয়মকানুন কিন্তু এই পেশায় নিযুক্ত অফিসারদের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে অধিকার ও রক্ষাকবচ দিয়ে রেখেছে, যাতে তাঁরা ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। তাই, কেবল দুর্নীতির কারণে সিভিল সার্ভিসে যোগ না দেওয়াটা একটা অজুহাত মাত্র।

এই সব নানা কারণে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ থেকে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার বাসনাটা চলে গেল। মেধাবী ছেলেমেয়েরা রাজ্যের বা দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে চলে গেল। পেশা হিসেবে বেছে নিল, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, শিক্ষকতা, ম্যানেজমেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি এবং বেসরকারি সংস্থার চাকরিকে। জেলাশাসক, সচিব, পুলিশের কর্তা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার অধিকর্তা বা কমিশনের সদস্য বা চেয়ারম্যান হওয়াটা নিতান্তই অর্থহীন হয়ে গেল বাঙালি যুবসমাজের কাছে।

এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিভিল সার্ভিস চাকরিতে যোগদানের সংখ্যা কমতে থাকল। ১৯৯১ সালে ১২৬ জন আইএএস পরীক্ষায় সফল হন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের। ২০০১-এ পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেউ এই পরীক্ষায় সফল হননি। ২০১১’তেও তা-ই। বস্তুত, অনেক বছরেই এমনটা হয়েছে। অথচ পড়শি রাজ্য বিহার-ওডিশা থেকে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি ছেলেমেয়ে এই পরীক্ষায় সফল হচ্ছে। আর একটা হিসেব দেওয়া যায়। ২০১১-য় গোটা দেশে আইএএস অফিসারের সংখ্যা ছিল ৩২২৯, এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের আইএএস ছিলেন মাত্র ৮৩। অথচ এর তিরিশ বছর আগে ১৯৮১ সালে দেশের ২৯৪৯ জন আইএএস অফিসারের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছিলেন ২৪৮ জন।

অথচ, পশ্চিমবঙ্গে ভারত-বিখ্যাত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি বা ম্যানেজমেন্ট পড়ার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমন একটি রাজ্য থেকে আইএএস-এ প্রায় কারও স্থান না পাওয়াটা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।

(চলবে)

অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন