নোটবন্দি মেয়েদের কী হল

বিরাট এক অর্থনৈতিক বিপ্লব হল। বিপ্লবের সেবাদাসী হয়তো হলেন না তাঁরা। পেলেন অনেক ব্যঙ্গ ও অপমান। চুপচাপ জমা হওয়া আরও কিছু চোখের জল, আরও কিছু রক্তক্ষরণ আবারও মনে করাল, মেয়েদের কথা কেউ মনে রাখেনি।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

নোটবন্দির এক বছর খুব ধুমধাম করে পালিত হল। সালতামামি হল, বিশেষজ্ঞরা মত দিলেন, রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষরা মিছিল করলেন, মিডিয়ায় প্রচুর তর্কবিতর্ক, আলোচনা হল। সব কিছুর মধ্যে না-বলা মানুষ বা বিষয় হয়ে থেকে গেল তারা, যারা নিজেদের কথা এখনও তেমন ভাবে বলে উঠতে পারে না। আর অন্যরা তাদের কথা বলে না, ভুলে যায় বা বলতে পছন্দ করে না— মেয়েরা।

Advertisement

৮ নভেম্বর, ২০১৭-র পরে কেমন থাকলেন বাড়িতে কর্মরতা মহিলারা, যাঁদের আমরা ‘হোমমেকার’ ইত্যাদি গালভরা নাম দিচ্ছি? নোটবন্দির ফলে রাতারাতি বাতিল হল ৫০০, ১০০০ টাকার নোট। সমাজমাধ্যম ছেয়ে গেল বাড়িতে থাকা মহিলাদের নিয়ে রসিকতায়। মহিলারা কেমন বাধ্য হলেন তাঁদের কালো টাকা বের করে দিতে— এই নিয়ে দাপদাপির শেষ রইল না। কেমন ‘কালো টাকা’? যে টাকার উপর সমান নৈতিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাঁদের হাত পেতে চাইতে হয়, পাওয়া বা না পাওয়া অর্থউপার্জনকারী পুরুষটির মর্জিনির্ভর। তাই টাকা না বলে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। হয়তো বাপের বাড়িতে অসুস্থ মায়ের জন্য ফল কিনে নিয়ে যেতে চান, হয়তো পাশের ফ্ল্যাটের কর্মরতা বান্ধবীর সঙ্গে বাইরে বেরোলে তাঁরও দু’পয়সা খরচ করতে মন চায়, হয়তো ছেলেটা কিছু বায়না করলে কিনে এনে দিয়ে চমকে দিতে চান। তাঁদের একমাত্র দোষ, না বলে নিয়েছেন। কিন্তু পরের দ্রব্য তো নেননি। বাড়ির কর্তাটি সত্যিই একেবারে জানেন না কি? সংসারের তেমন দরকারে উনিও যে এই ‘কালো টাকা’র থেকে নেননি, তা তো নয়। তবে পুরুষের টাকার উপর অধিকার বড় স্বতঃসিদ্ধ, তাই তাঁকে হাত পাততে হয় না, শুধু প্রয়োজনটুকু বললেই হল। প্রশ্ন তাই একটাই। মহিলাদের টাকা লুকিয়ে রাখতে হয় কেন?

কিন্তু নোটবন্দির চাপে শেষ পর্যন্ত এই ‘কালো টাকা’ বের করতে বাধ্য হচ্ছিলেন মহিলারা। ঠাকুরঘরে জমানো হাজার টাকা, তোষকের তলায় তিন হাজার, ছেলেকে নতুন মোবাইল ফোন কিনে চমকে দেবেন বলে যে দশ হাজার টাকা রেখেছিলেন, তার ভেতরে ৫০০, ১০০০ কতই আছে— এক দিনের নোটিসে বাতিল হয়ে গিয়েছিল। যাঁদের শেন্যদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে সঞ্চয় করেছিলেন তাঁদের হাতে তুলে দিতে হচ্ছিল। সঞ্চয় তো গেলই, রসিকতা, অপমানের শেষ রইল না।

Advertisement

কিন্তু কেন বের করে দিতে হল? তাঁরা যে ভাবে সঞ্চয় করেছিলেন, সে ভাবেই নোটগুলো বদলে নিতে পারলেন না? বা ব্যাংকে জমা দিতে পারলেন না, যে ভাবে বাড়ির পুরুষরা দিচ্ছিলেন? কী করে পারবেন? ইউএনডিপি রিপোর্ট অনুযায়ী ৮০ শতাংশ মহিলার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, মহিলারা ৯৫ শতাংশ কেনাকাটা করেন নগদে। আর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলে তা বরের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। যদি বা একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, তা ব্যবহার করেনই বা কত জন?

ধরে নেওয়া যাক, লুকোনো টাকাটা মহিলার (জয়েন্ট বা পার্সোনাল) অ্যাকাউন্টেই পড়ল। উদ্ধার হল ‘কালো টাকা’। এ বার? সেই মহিলা টাকাটি ব্যবহার করবেন কী ভাবে? ধরে নেওয়া যাক, তিনি মোটামুটি ব্যাংকের কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়ার মতো লেখাপড়া জানেন। সে ক্ষেত্রেও ৮ নভেম্বরের আগে আর পরে গৃহবধূটির মায়ের জন্য ফল কিনে নিয়ে যাওয়া আগের মতো সহজ রইল না। বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল ফুড স্টোরে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ফল কেনা যায়। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন কত জন মহিলা? ধরে নিলাম পাড়ার ফলের দোকানে পেটিএম বসে গেছে তৎক্ষণাৎ। ধরে নিই বধূটি পেটিএমের কর্মপদ্ধতি শিখে নিয়েছেন। স্বামী যা শিখতে পেরেছেন, তিনি তা শিখতে পারবেন না কেন?

সমস্যা অন্য জায়গায়। কার্ড ব্যবহার শিখে ফেললেও তো রেহাই নেই। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট হলে খবর পৌঁছবে কর্তার কাছে। ঠিক কতটা খরচ করে ফল কেনা হয়েছে। অনেক কষ্টে সঞ্চিত, অর্জিত মায়ের জন্য ফল কেনার স্বাধীনতাটুকু মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে ‘আবার ফল নিয়ে যাওয়ার কী দরকার’, ‘সেদিনও তো কিনেছিলে’ ধরনের বক্তব্যে।

এটা ঠিক যে, ৮ নভেম্বরের অভিঘাতে অসুবিধে বাড়ির পুরুষমানুষটিরও কম হয়নি। বিশেষত তিনি যদি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারের কর্তা হন। কী ভাবে মুদির দোকানে ধারে পাউরুটি, ডিমের ব্যবস্থা করা যায় বা মাছওয়ালার থেকে নগদ ছাড়া সপ্তাহের কাটাপোনা নেওয়া যায়, সেটা তাঁকেই ভাবতে হয়। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ কর্তার পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর অবস্থার পার্থক্য হল এই যে, তিনি যদি মাছওয়ালার কাছে বা মুদির দোকানে মাসকাবারির ব্যবস্থাটি করে ফিরে আসতে পারেন, বাড়িতে তাঁর বিশ্বজয়ীর অভ্যর্থনা। যদি না পারেন, ‘বোঝো তো না বাইরের অবস্থা’ বলে হতাশা ঝেড়ে ফেলবেন। মেয়েদের সে উপায় নেই।

বিরাট এক অর্থনৈতিক বিপ্লব হল। বিপ্লবের সেবাদাসী হয়তো হলেন না তাঁরা। পেলেন অনেক ব্যঙ্গ ও অপমান। চুপচাপ জমা হওয়া আরও কিছু চোখের জল, আরও কিছু রক্তক্ষরণ আবারও মনে করাল, মেয়েদের কথা কেউ মনে রাখেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন