পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনার উদ্যোগটি মস্ত ক্ষতি করবে

ফেল করানোর যুক্তি

যে কোনও ক্লাসে নম্বরের নিরিখে সবচেয়ে পিছনে এই কন্যাদল, তবুও এরা স্কুলে আসে। কিন্তু ফাঁকিটা ঠিক কোথায় বোঝার আগেই এদের পিছিয়ে পড়ার জন্য— সাব্যস্ত হয়ে গেল— এরাই দোষী, এবং, একমাত্র এরাই।

Advertisement

মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৭ ০০:২১
Share:

হুমায়রা আর সায়রা। যমজ বোন, চেহারায় এতই মিল যে বাবাও মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলেন। এখন সপ্তম শ্রেণি, বেশ বেড়ে উঠেছে দুটোতেই। মিড-ডে মিলে রোজ হাজির, স্কুলে প্রতিদিন হরেক দুষ্টুমি— এই সবের মধ্যে লেখা পড়া কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে হাসিটা কেমন মিইয়ে যায়।

Advertisement

কিংবা পার্বতী টুডু— সব দিন স্কুল আসে না, এলেও মিড-ডে মিলের পর পালাই-পালাই ভাব, কিন্তু খেলাধুলায় সবার আগে। চেষ্টা আছে, প্রাইভেট টিউশনও আছে, তবু কোথায় যেন একটা মস্ত ফাঁকি।

যে কোনও ক্লাসে নম্বরের নিরিখে সবচেয়ে পিছনে এই কন্যাদল, তবুও এরা স্কুলে আসে। কিন্তু ফাঁকিটা ঠিক কোথায় বোঝার আগেই এদের পিছিয়ে পড়ার জন্য— সাব্যস্ত হয়ে গেল— এরাই দোষী, এবং, একমাত্র এরাই। বঞ্চনা থেকে এ বার বর্জনের পালা। শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯), যা তাদের পড়ার অধিকার দিয়েছিল, অন্তত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভয়মুক্ত ও ভারমুক্ত শিক্ষার। সে অঙ্গীকারে জল ঢেলে ফিরে আসছে পাশ-ফেল, বলা ভাল পাশ নয়, ফেল করানোর ব্যবস্থা। আইন অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও ছাত্রছাত্রীকে ফেল করানো যাবে না। এ আইন যখন পাস হল, সংসদে প্রায় সব দলের প্রতিনিধিই সমর্থন জানিয়েছিলেন, অন্তত কেউ বিরোধিতা করেননি। কিন্তু বলবৎ হওয়ার
পর থেকেই নানা রাজ্যে ‘গেল গেল’ রব। ‘প্রগতিশীল’ সমাজতন্ত্রী, এবং বন্ধনীভুক্ত সাম্যবাদীরাও মাঠে নেমে পড়লেন। ছাত্রছাত্রীদের মতামত কেউ জানতে চাননি।

Advertisement

এই আইনের কারণে প্রচলিত বার্ষিক পরীক্ষার বদলে চালু হয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন, যদিও তার লিখিত অংশটি বাদ দিয়ে বাকিটা সম্পর্কে ধোঁয়াশা এখনও যায়নি। আইনের ফলে স্কুলছুট কমেছে, ভর্তিও বেড়েছে। সবাই জানেন বিনা ব্যয়ে শিক্ষার আসল খরচ কত। কিছু না হোক ‘প্রাইভেট’-এর খরচ তো আছেই। একই মেয়েকে যদি বছরের পর বছর একই ক্লাসে থাকতে হয়, পরিবার হয় তার বিয়ে দিয়ে দেবে অথবা সে নিযুক্ত হবে শিশুশ্রমে (ইতিমধ্যেই সেখানেও নতুন আইন অনেক ছাড় মিলেছে)। তথ্য বলে, স্কুল-ছুটের অন্যতম প্রধান কারণ ফেল করা। তার পরে আসে বাল্যবিবাহ, ছোট ভাই বোনেদের দেখাশোনা করা বা খেতখামারে কাজ করার মতো কারণ।

প্রশ্ন হল, শিক্ষার যে এই বিরাট কাণ্ডকারখানা— সর্বশিক্ষা অভিযান, রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান, দফতরের পর দফতর, প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণ এবং দফায় দফায় তথ্য-পরিসংখ্যানের তলব— এর পরেও ‘কাঙ্ক্ষিত মান’-এ না পৌঁছনোর দায় শুধু, এবং শুধুই, ওই ছাত্রী বা ছাত্রটির? বছরের পর বছর যাঁরা পাঠ্যপুস্তক বদলাছেন এবং মরজিমাফিক পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন, তাঁদের কারও কি সময় হয়েছে ওই ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে জানার যে, বইগুলি তার কেমন লাগছে। কেউ কি খোঁজ করেছেন প্রায় সকলকেই (সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপকেও) কেন একাধিক টিউশন পড়তে হয়। অস্বাভাবিক ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষক-নিয়োগ সংক্রান্ত বিবিধ সমস্যা, ইত্যাদি দূর না করেই আইনের পরিবর্তন কোন যুক্তিতে হল বোঝা গেল না। গেল না, কারণ এটা গণতন্ত্র। আর আমাদের গণতন্ত্র মানে ভোট জিতে ক্ষমতায় আসা লোকেদের সর্বজ্ঞ হয়ে ওঠা। ভোটে জেতানোর অর্থ যে যাঁদের ভোটে জিতলেন বা হারলেন তাঁদের কথা শোনা, এ বোধ এ পোড়া দেশে কবে জন্মাবে, কে বলতে পারে? সব দায় নিয়ে এখন ওই ছেলেমেয়েরা সারাজীবন ফেল করার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াবে, বন্ধুবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, নিজের উপর আস্থা হারাবে আর পরিবার ও গোটা সমাজ কিশোর মনে এই কথাই ছেপে দেবে— তোর দ্বারা কিস্যু হবে না। এই ‘তোর’ হয়ে যাবে ‘তোদের’, যাদের দ্বারা কিছু হয় না বলেই গোটা ব্যবস্থা মনে করে। কারা এরা? বার বার একই উত্তর: প্রান্তিক মানুষ, সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, জনজাতি। গুণগত মান বৃদ্ধির ব্যপারে গোটা ব্যবস্থার ফেল করার দায় নিয়ে এরাই বর্জিত হবে।

জানা নেই কোন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, শিক্ষায় গুণগত মান উন্নয়নের উপায় একই ক্লাসে ছাত্রকে বছরের পর ধরে রাখা? ছাত্রীরা, ছাত্ররা স্কুলে আসে পড়বার জন্য, শিখবার জন্য, পাশ করবার জন্য— ফেল করার জন্য নয়। তারা নিজেরাই যদি সব করে নিতে পারত, স্কুলের দরকার হত না, মাস্টারের, শিক্ষাব্যবস্থার দরকার হত না। এত বড় বড় শিক্ষানির্মাতা এই সহজ সত্যটা না বুঝে, স্কুলব্যবস্থার পরিবর্তনে উদ্যোগী না হয়ে শিশুদের উপর চাপিয়ে দিলেন তাদের ‘ব্যর্থতা’র দায়। অথচ, আজ অবধি নির্ণীত হল না শিক্ষার সাফল্যের মাপকাঠি কী। প্রতিযোগিতায় জিতে নম্বরের ঝুড়ি বওয়া, না কি এক শিক্ষিত মন তৈরি হওয়া, যা মানুষকে মানুষ করে তোলে। স্কুল কি শুধুই নম্বর পাওয়ানোর কোচিং সেন্টারের বৃহৎ সংস্করণ, না কি সেখানে বেড়ে উঠতে উঠতে জীবনের পাঠশালায় মানুষের পূর্ণ বিকাশ ঘটে, যা তাকে অধিকারসচেতন করে। রবীন্দ্রনাথ বা অমর্ত্য সেন নন, শিক্ষার সংজ্ঞা এখন ঠিক করে দিচ্ছে বাজারের মধ্যস্থতাকারী মধ্যমেধা, যা বিশ্বসংসারের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেও কণামাত্র গ্রহণ করতে অপারগ।

অথচ ফেলবিহীন এই ব্যবস্থাকে অনায়াসেই আনন্দময় শিক্ষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসাব গড়ে নেওয়া যেত, যেখানে পরীক্ষার ভয় নেই, নম্বরের জুজু নেই, শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক ক্ষমতার নয়, ঠিক অর্থে ভারমুক্ত। তার জন্য যথার্থ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, প্রশিক্ষণ এবং সর্বোপরি যথোপযুক্ত পাঠ্যক্রম দরকার। একটি নির্দিষ্ট বয়সে যে বিষয়গুলি ছাত্র বা ছাত্রীর আয়ত্ত করা উচিত, ধাপে ধাপে সেই পর্যন্ত পৌঁছতে সহায়ক হওয়া যেত। সিলেবাস শেষ করার তাড়া দিয়ে সেটা হয় না।

সর্বোপরি ফেল করানোর দাবি নিয়ে যদি আন্দোলন হয়, আর ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনতে প্রকাশিত হয় উল্লাস, তা হলে সমাজের অসুখটা কত গভীর, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক। অথচ, শিক্ষক সংগঠনগুলোও যেন বাজারের কাছে তাঁদের বিবেক ও বিচারবুদ্ধি বন্ধক রেখে দিয়েছেন। সত্যিই কি মনেপ্রাণে সকলের জন্য শিক্ষা চাওয়া হচ্ছে? না কি বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে যারা প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, সামান্য হলেও স্কুলের মধ্য থেকে অন্য এক আকাশের এক ফালিও দেখতে পাচ্ছে, তাদের আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়াই ‘কাঙ্ক্ষিত মান’? পাশফেল-এর দাবির আড়ালে নতুন করে লেখা হচ্ছে অন্য এক গল্প— সবার জন্য শিক্ষা নয়, শিক্ষা পাবে কতিপয়!

হুমায়রা, সায়রা, পার্বতীরা বলছে, কিছুই কি শিখিনি আমরা? এই যে এত পথ পেরিয়ে আসা, ভাষা ও সংস্কৃতির বাধা পেরিয়েও বোঝার চেষ্টা করা, কিছুটা সময় বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা, নানান অনুষ্ঠানে বৃহত্তর সমাজকে খানিকটা দেখা— এ সবের মধ্য দিয়ে স্কুল কখনও কখনও বাড়ির চেয়েও বেশি আপন হয়ে ওঠে। দিদিমণির কাছে মনের কথা খুলে বলা যায়, জীবনে নতুন পথ পাওয়া যায়, কিন্তু এ সমস্ত দিয়ে ‘পাশ’ করা যাবে না নিশ্চয়!

দিন ঘনিয়ে এল। সকলের টাকায় সকলের শিক্ষার যে প্রশস্ত অঙ্গনের আভাসটুকু পাওয়া যাচ্ছিল, তা এখন পুনরায় ধনাঢ্যের বৈঠকখানায় পরিণত হতে চলেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন