প্রবন্ধ ১

লৌহ-মানবী

রাজনীতিতে সাময়িক এলোমেলো সময়টাই কিন্তু ইন্দিরার ভিতরের শক্তিটা বের করে এনেছিল।... ১৯৭৭ সালের নির্বাচন ও তার পরের এক বছরে ইন্দিরা গাঁধীর দিনগুলির স্মৃতিচারণে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। দিল্লিতে ১৯ নভেম্বর প্রদত্ত ইন্দিরা গাঁধী জন্মশতবর্ষ স্মারক বক্তৃতার অংশবিশেষ।জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে যে ভোট হল, কংগ্রেস তথা শ্রীমতি গাঁধীর তাতে বিপুল পরাজয় হল। জনতা পার্টির ২৯৫টা আসনের পাশে কংগ্রেস পেল মাত্র ১৫৪। ইন্দিরা নিজেও রায় বরেলীতে ৫৫ হাজার ২০২ ভোটে হেরে গেলেন। (স্বাধীনতার) তিরিশ বছরে এই প্রথম কংগ্রেস বিরোধী আসনে বসল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৮
Share:

জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে যে ভোট হল, কংগ্রেস তথা শ্রীমতি গাঁধীর তাতে বিপুল পরাজয় হল। জনতা পার্টির ২৯৫টা আসনের পাশে কংগ্রেস পেল মাত্র ১৫৪। ইন্দিরা নিজেও রায় বরেলীতে ৫৫ হাজার ২০২ ভোটে হেরে গেলেন। (স্বাধীনতার) তিরিশ বছরে এই প্রথম কংগ্রেস বিরোধী আসনে বসল।

Advertisement

এই পরাজয়ের পূর্ণ দায়িত্ব কিন্তু ইন্দিরা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি গত ১১ বছর ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়েছি। এখনকার এই ব্যর্থতার দায় আমারই। মানুষের সামগ্রিক ভাবে যে রায় দিয়েছেন, তাকে সম্মান করা উচিত। আমি খোলা মনে নম্রতার সঙ্গে এই রায় মাথা পেতে নিচ্ছি।...আমি সব সময় বলেছি এবং মন থেকে বিশ্বাস করেছি যে একটা ভোট জেতা-হারার থেকে দেশকে শক্তিশালী করা আর দেশের মানুষের জীবনকে উন্নত করার কাজটা অনেক বড়।

ভোটের পরের সেই সময়টা ইন্দিরাজির পক্ষে ভীষণই প্রতিকূল ছিল। জনতা পার্টি তো বটেই, কংগ্রেসেরও একটা বড় অংশ তখন তাঁর বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা ছড়াচ্ছিল। সংবাদমাধ্যমও পুরোপুরি তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। দেশ জুড়ে তখন ইন্দিরা-বিরোধী মিছিল হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের মুখে স্লোগান, ‘‘ইন্দিরার ফাঁসি চাই!’’

Advertisement

(জরুরি অবস্থার সময়কার নানা ঘটনার তদন্তে) তখন এক দিকে শাহ কমিশন গঠন করা হচ্ছে। অন্য দিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ইন্দিরার ‘অপরাধের’ বিচার নাকি ন্যুরেমবার্গের মতো করে হওয়া উচিত। অজস্র খুচখাচ মামলা ইন্দিরার নামে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। মনে আছে, মণিপুরে মুরগি আর ডিম চুরি করার অভিযোগেও তাঁর নামে মামলা হয়েছিল!

এক বার ১৯৭৮ সালে আমরা অসমে গিয়েছি। রাস্তায় ইন্দিরাজির খুব তেষ্টা পেয়েছে, এক কাপ চা খেতে চাইলেন। হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিলাম আমরা। রাস্তার পাশের ধাবাগুলো ধুলোয় ভরা, নোংরা। কাছেই একটা চা-বাগান ছিল। বাগানের মালিক কংগ্রেস সমর্থক। আমি ইন্দিরাজিকে বললাম, আমরা বরং বাগানের বাংলোয় যাই! সেখানেই চা খাওয়া যেতে পারবে। কিন্তু বাগানের মালিক বাংলোর দরজাই খুললেন না। পাছে ইন্দিরার সঙ্গে তাঁকে কেউ দেখলে তিনি বিপদে পড়েন! এক গেলাস জলও এগিয়ে দিলেন না তিনি। অথচ সমস্ত রকম মামলা-মোকদ্দমা ঘাড়ে নিয়ে ইন্দিরা নিজে ছিলেন অবিচল। সব সময় বলতেন, ‘‘আমরা লড়াই করে ঠিক বেরিয়ে যাব।’’

ক’টা মাস মাত্র নিয়েছিলেন ইন্দিরা, স্ব-আরোপিত অন্তরাল থেকে বেরোতে। তার পরেই দেশের নানা প্রান্তে ঘুরতে শুরু করলেন অক্লান্ত। বিনোবা ভাবে, জেপি-র মতো মানুষের সঙ্গে দেখা করলেন। ইন্দিরাজির দিন শুরু হতো ভোর ছ’টায়। রাত তিনটে পর্যন্ত কাজ করতেন। প্রায়শই তাঁর সভায় অশান্তি লেগে থাকত। বিক্ষোভ, হেনস্থা, বিশৃঙ্খলা। শিলচরে এক বার আমার গায়ে পাথর এসে পড়েছিল। ইন্দিরাজি কিন্তু সব সময় হাসিমুখে থাকতেন। তাঁর ওই অদম্য জোরই তাঁর আশপাশের মানুষগুলোর মনকে ভাঙতে দিত না।

ইন্দিরার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে, বিশেষত তৃণমূল স্তরের কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগ। মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অসম্ভব লড়াকু আর দৃঢ়চেতা একটি মুখ। বিহারের নালন্দা জেলার বেলচিতে এগারো জন দলিতকে খুন করা হল। ইন্দিরা ছুটে গেলেন। বেলচিতে ঢোকার মতো পাকা রাস্তা নেই। ইন্দিরা বললেন, ‘‘আমরা তেমন হলে হেঁটে যাব। পৌঁছতে যদি সারা রাত লেগে যায়, তবুও যাব।’’ কাঁচা পথ কাদায় ভরা। ইন্দিরার জিপ একটু পরেই সেই কাদায় আটকে গেল। ট্রাক্টর ডাকতে হল গাড়িটাকে কাদা থেকে তোলার জন্য। ইন্দিরা সত্যি গাড়ি থেকে নেমে কাদার মধ্যে হাঁটতে শুরু করলেন। শাড়িটা গুটিয়ে নিলেন গোড়ালির উপরে। ওই ভাবে হেঁটে চলা প্রতি মুহূর্তে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিল। ইন্দিরা তাও দমবার পাত্রী নন। খানিক পরে একটা হাতি দেখে উনি তাতেই চড়ে বসলেন। সাড়ে তিন ঘণ্টা ওই ভাবে গিয়ে বেলচি পৌঁছনো, আর কোনও জাতীয় নেতা কখনও করেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ইন্দিরা ঠিক করে নিয়েছিলেন, বেলচিতে যাবেনই। সেই হিম্মত আর দলিতদের উন্নয়নের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা তাঁর ছিল। অনুন্নত, শোষিত জনতার ত্রাতা হিসেবে যে তাঁকে দেখা হতো, সেটা এই কারণেই।

১৯৭৮ সালে কংগ্রেসে দ্বিতীয় বার ভাঙন ধরল। ইন্দিরাজি দলের নাম, পতাকা, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, দলের সদর দফতর, এমনকী নির্বাচনী প্রতীকও হারালেন রেড্ডি কংগ্রেসের কাছে। সেই সময় কংগ্রেস পার্টির কোষাগারের যা হাল, টাকা তুলতে আমরা তখন ইন্দিরাজির ফটোগ্রাফ বিক্রি করতাম। প্রতিটি অটোগ্রাফের দাম ধরা হয়েছিল দু’টাকা আর অটোগ্রাফওয়ালা ছবির দাম পাঁচ টাকা। ...

১৯৭৭-এর ভোটের এক বছর কেটে যাওয়ার পরেও ইন্দিরাজির উপরে আক্রমণ থামেনি। সেটা বরং এ বার সংসদে এসে পৌঁছল। লোকসভায় আরও কয়েক জনের সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধেও স্বাধিকারভঙ্গের অভিযোগ আনলেন জনটা পার্টির মধু লিমায়ে এবং কানওয়ারলাল গুপ্ত। সেটা ১৯৭৮-এর ১৬ নভেম্বর। মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড-এর ব্যাপারে কিছু সরকারি অফিসার তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। অভিযোগ উঠল, ইন্দিরা তাঁদের কাজে বাধা দিয়েছেন, তাঁদের শাসিয়েছেন, হেনস্থা করেছেন, তাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন। ১৮ নভেম্বর বিষয়টি প্রিভিলেজ কমিটিতে যাবে বলে সংসদে ঠিক হল। ১৯ ডিসেম্বর লোকসভায় এই মর্মে প্রস্তাব পাশ হল যে, চলতি অধিবেশনের জন্য ইন্দিরাকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হোক এবং তাঁকে গ্রেফতার করা হোক।

প্রস্তাব পাশ করে অধিবেশন সেদিনকার মতো স্থগিত হয়ে গেল বিকেল পাঁচটা পাঁচ মিনিটে। ইন্দিরাজি প্রায় তিন ঘণ্টা সংসদে বসে রইলেন, যত ক্ষণ না সমস্ত আইনি কাজকর্ম মিটল। ওঁর সঙ্গে সেদিন আমরা অনেকে ছিলাম। রাজীবজি আর সনিয়াজিও ছিলেন। আমাদের সকলেরই মন একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। ইন্দিরাজি তখনও আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে ইংরেজি কবিতার লাইন ধার কর বললেন, ‘‘সে গুডবাই নট উইথ টিয়ার্স বাট উইথ স্মাইলস। চোখে জল নিয়ে বিদায় বলতে নেই, হাসিমুখে বলতে হয়।’’...

রাজনীতিতে এই সাময়িক এলোমেলো সময়টাই কিন্তু ইন্দিরার ভিতরের শক্তিটা বের করে এনেছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement