চৌহাট্টার সাধক-কবি সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

সাংসারিক কাজকর্ম ছেড়ে বাড়ির ফুলের বাগানের পাশে বসে পদ রচনা করতেন আর গুনগুন করে গাইতেন সতীশচন্দ্র। লাভপুরের ফুল্লরা মন্দিরে, কঙ্কালীতলায়, তারাপীঠে যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানে বসেই পদ রচনা করেছেন আর গেয়েছেন। লিখলেন সুনীল পাল।সাংসারিক কাজকর্ম ছেড়ে বাড়ির ফুলের বাগানের পাশে বসে পদ রচনা করতেন আর গুনগুন করে গাইতেন সতীশচন্দ্র। লাভপুরের ফুল্লরা মন্দিরে, কঙ্কালীতলায়, তারাপীঠে যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানে বসেই পদ রচনা করেছেন আর গেয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:২৬
Share:

সতীশ স্মৃতি পাঠাগারে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি। ছবি:লেখক

চৌহাট্টার এই চন্দ্রচূড় শিবমন্দিরের প্রাঙ্গণে (সঙ্গের ছবি) বসেই বহু গান রচনা করেছেন তিনি। মন্দিরের জীর্ণদশা দেখে গেয়েছিলেন, ‘‘হে প্রভু পিনাকী, ভগ্নচূড়া দেখি ঝরে দু’টি আঁখি, হয়না নিবারণ।’’ তাঁর এই আক্ষেপ অবশ্য দূর হয়েছিল তাঁর শেষ জীবনে। মন্দিরের সংস্কার হয়েছিল।

Advertisement

তিনি সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। লাভপুরের চৌহাট্টা এই সাধক-কবির জন্মভূমি। বাবা রঘুনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল বোলপুরের কাছে সুরুল গ্রামে। তিনি চৌহাট্টার দীনবন্ধু মজুমদারের একমাত্র কন্যা বরদাসুন্দরীকে বিয়ে করে এই গ্রামেই বাস করতেন। এখানেই ১২৭৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে জন্ম হয় সতীশচন্দ্রের। তারেশচন্দ্র নামে আর এক পুত্র এবং দুই কন্যাও ছিল রঘুনাথের। তিনি বাড়িতে একটি পাঠশালা খুলেছিলেন, সতীশচন্দ্র এবং তারেশচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষালাভ সেখানেই। এর পরে সতীশচন্দ্র পড়েন সুরুলের মধ্য বাংলা স্কুলে এবং তার পরে ভর্তি হন বাঁধগোড়া হাই স্কুলে— আজ যে স্কুলের নাম বোলপুর হাইস্কুল।

কিন্তু তারেশচন্দ্রের সহপাঠী এবং সতীশচন্দ্রেরও বন্ধু চৌহাট্টার তারক চট্টোপাধ্যায় বলতেন অন্য কথা। তিনি বলতেন, সতীশচন্দ্র মধ্য বাংলা স্কুলে পড়ার পরে কিছুদিন হুগলির নরম্যাল স্কুলে পড়েছিলেন। সে যাই হোক, সতীশচন্দ্র মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদের অভিরামপুরের একটি বাংলা স্কুলের হেড পণ্ডিতের কাজ নিয়ে চলে যান। কিন্তু সে কাজও বেশিদিন ভাল লাগেনি তাঁর। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে গ্রামেই এসে বসবাস করতে থাকেন।

Advertisement

১৫-১৬ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন পাশের গ্রাম ভালকুটির মহানন্দ চৌধুরীর আট বছর বয়সী কন্যা গোবিন্দমোহিনীকে। দু’টি মেয়েও হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু তবু সংসারে মন বসেনি। সাংসারিক কাজকর্ম ছেড়ে বাড়ির ফুলের বাগানের পাশে বসে পদ রচনা করতেন আর গুনগুন করে গাইতেন সতীশচন্দ্র। লাভপুরের ফুল্লরা মন্দিরে, কঙ্কালীতলায়, তারাপীঠে যখন যেখানে গিয়েছেন, সেখানে বসেই পদ রচনা করেছেন আর গেয়েছেন। শাক্ত পদ, বৈষ্ণব পদ তো বটেই, আবার কোনও কোনও পদে শাক্ত-বৈষ্ণবের ভেদরেখা মুছে একাকার হয়ে গেছে। ‘বনমালা সনে মুণ্ডমালার মোহন মিলন’ ঘটিয়েছিলেন তিনি। এ ভাবেই প্রায় সাড়ে চারশো পদ রচনা করেছিলেন। প্রথম দিকে গ্রামেরই সুকণ্ঠ বৈষ্ণব গায়ক বহুবল্লভ দাসকে সে-সব পদের অনেকগুলি শিখিয়েছিলেন তিনি। পরে আরও অনেকের কণ্ঠে ‘সতীশের পদ’ নামে সেগুলি জনপ্রিয়তা পায়। কালিয়দমন যাত্রাপালার বিখ্যাত অধিকারী নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় একবার চৌহাট্টার বাসন্তীতলায় যাত্রাগান গাইতে এসেছিলেন। সতীশচন্দ্রের পদের পরিচয় পেয়ে তিনি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করেছিলেন। সাধক কবি নীলকণ্ঠমশাইও আসরে বসেই গান রচনা করে সঙ্গে সঙ্গে তা গাইতে পারতেন। তাঁর মতো গুণী মানুষ প্রথম দর্শনেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সতীশচন্দ্রের প্রতিভার মহিমা।

কিন্তু ১৩২২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে সতীশচন্দ্রের মৃত্যুর পরে এই সব পদের অধিকাংশই হারিয়ে যায়। বহুদিন পর ১৯৬২ সালে সতীশ স্মৃতি সাংস্কৃতিক পরিষদের উদ্যোগে বহু পরিশ্রমে ১২৬টি পদ উদ্ধার করে ‘বীরভূমের হারানো মাণিক সতীশচন্দ্রের পদ-সংগ্রহ’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির সম্পাদনা করেছিলেন বীরভূমের আর এক কবি কমলাকান্ত পাঠক, আর সে বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বহু আগে ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যায় সতীশচন্দ্রকে নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন কমলাকান্ত। তিনি তাঁর বাল্যকালে স্বগ্রাম মোনাচিতুরায় বসে বহুবল্লভ দাসের কণ্ঠে গান শুনেই সতীশচন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

সতীশ স্মৃতি সাংস্কৃতিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। তার সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র পাঠক, সম্পাদক সিরাজুল হক। বই প্রকাশের আগে আর একটি কাজও করেছিল পরিষদ। ১৯৫৯ সালে সতীশ স্মৃতি সম্মেলন এবং বীরভূম সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল চৌহাট্টায়। সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন চৌহাট্টার বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্যামাদাস শাস্ত্রী। হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলাকান্ত পাঠক, কালীকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে সে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বীরভূমের আরও অনেক লেখক সাহিত্যিক। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সতীশচন্দ্রকে নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছিল সে সম্মেলনে। কিন্তু তারও আগে ১৯৫৩ সালে সতীশচন্দ্রের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে গ্রামের যুবকদের প্রচেষ্টায় চৌহাট্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সতীশ স্মৃতি পাঠাগার। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গোসাঁইদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে পেয়েছিলেন গ্রামের রামনারায়ণ, অনিলকুমার, বিশ্বনাথ, বিপ্রদাস, ও হেমেন্দ্র এবং ভালাসের বিশিষ্ট কর্মী নির্মল সিংহকে। সতীশ স্মৃতি পাঠাগারের প্রথম গ্রন্থাগারিক ছিলেন হেমেন্দ্রলাল মজুমদার। স্বাধীনতার পরে ১৯৫৭ সালে একেবারে প্রথম পর্যায়ে বীরভূম জেলার যে কয়েকটি লাইব্রেরি সরকারি স্বীকৃতি পায়, এটি সেগুলির অন্যতম।

তাঁর এই ৮৯ বছর বয়সেও গোসাঁইদাসবাবু মাঝে মাঝেই লাইব্রেরিতে আসেন। তাঁর মুখ থেকেই জানা গেল গ্রন্থাগারটি স্থাপনের ইতিহাস। অনেক কষ্টে একটি আলমারি আর সামান্য কিছু বই জোগাড় করে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। বার দুয়েক স্থান পরিবর্তনের পরে ন’কড়ি সরকার, বাঁকাশ্যাম সরকার ও তাঁদের শরিকদের এবং মুক্তিপদ ভট্টাচার্য ও গোসাঁইদাসবাবুর দেওয়া জমির উপর গড়ে উঠেছিল লাইব্রেরির নিজস্ব গৃহ। সে ভবন এখন বহু কক্ষবিশিষ্ট ও দোতলা। গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে সতীশচন্দ্রের একটি আবক্ষ মূর্তিও নির্মিত হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থাগারিক অরূপ চৌধুরী জানালেন, এখন এই লাইব্রেরির সদস্য সংখ্যা ২৮২, বইয়ের সংখ্যা ৭০৬৭।

প্রথমেই বলেছি, চন্দ্রচূড় মন্দিরের ভগ্নদশা নিয়ে আক্ষেপ ছিল সতীশচন্দ্রের। তবে নিজের শেষ জীবনে মন্দিরের সংস্কারও দেখে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সর্বশেষ সংস্কারের পরে এখন সে মন্দিরের অন্য রূপ। চারদিকে পাঁচিল ঘেরা বেশ বড় বাঁধানো অঙ্গন। আশপাশে বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য মূর্তি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নহবত এবং ঢাকের বাদ্যসহ ‘শীতল’ বা আরতির ব্যবস্থা। ঢাকি, পুরোহিত, মন্দিরের সাফাইকর্মী সকলের জন্যই জমি দেওয়া আছে। মন্দিরের জমিতে একটি আমের বাগানও গড়ে উঠেছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের সময় মেলা বসে। সবকিছু দেখভালের জন্য আছে একটি কমিটি।

সতীশচন্দ্রের বংশের কেউ আজ আর চৌহাট্টায় নেই। তাঁর জন্মভিটেও বেহাত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাঁকে মনে রেখেছেন তাঁর নামে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে। আর এক দিন মন্দিরের জীর্ণদশা দেখে যে জল ঝরেছিল সতীশচন্দ্রের চোখ থেকে, সে জলও তাঁরা মুছিয়ে দিয়েছেন মন্দিরের প্রভূত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে।

(লেখক সাহিত্যকর্মী ও প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন