সম্পাদকীয় ২

পুরস্কার তুমি কাহার

পুরস্কার ফিরাইয়া লওয়া কি আদৌ উচিত? এক জনকে পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁহার সেই সময় অবধি কৃত কাজের স্বীকৃতি হিসাবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০৯
Share:

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফিরাইয়া লইল মায়ানমারের নেত্রী সু চি-কে প্রদত্ত ‘ফ্রিডম অব অক্সফোর্ড’ সম্মান। তিনি মানবাধিকারের জন্য লড়াই করিয়া উক্ত সম্মান পাইয়াছিলেন, আজ যখন রোহিঙ্গা সংকটে অসংখ্য মানুষের অধিকার বিপর্যস্ত, তিনি নীরব। তাই তাঁহাকে প্রদত্ত বহু সম্মানই ফিরাইয়া লইবার দাবি উঠিয়াছে, এমনকী নোবেল শান্তি পুরস্কারও। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার কয়েক জন প্রাপক ফিরাইয়া দিতেছেন, রাষ্ট্রের কোনও অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে, এমন বহু ঘটিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ফিরাইয়া দেওয়া এক উজ্জ্বল উদাহরণ। মোদী সরকারের প্রশ্রয়ে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও বিপন্ন বাক্‌স্বাধীনতার প্রতিবাদে বহু লেখক সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফিরাইয়া দেন। কিন্তু পুরস্কারদাতাই পুরস্কার ফিরাইয়া লইতেছেন, বড় একটা ঘটে নাই। বাংলা প্রবচন অনুযায়ী, প্রদত্ত বস্তু ফিরাইয়া লইলে পরজন্মে নিকৃষ্ট জীব হইয়া জন্মাইবার সম্ভাবনা। তাহা উড়াইয়া, অক্সফোর্ডের কাজটি মহিমার জ্যোতি পাইতেছে বিস্তর।

Advertisement

পুরস্কার ফিরাইয়া লওয়া কি আদৌ উচিত? এক জনকে পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁহার সেই সময় অবধি কৃত কাজের স্বীকৃতি হিসাবে। ধরা যাক এক লেখককে পুরস্কার দেওয়া হইল উত্তম কাব্য লিখিবার জন্য। তিনি যদি পরের দিন হইতে জঘন্য কাব্য রচনা করেন, তবে কি সেই পুরস্কার ফিরাইয়া লওয়া যুক্তিযুক্ত হইবে? কখনওই না, কারণ তাহাতে তো লেখকের পূর্বের লেখাগুলি নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতেছে না। যে কোনও মানুষ যে কোনও মুহূর্তে বদলাইয়া যাইতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অ-ভূতপূর্ব ব্যবহার শুরু করিতে পারেন। বহু বৎসর ধরিয়া অসংখ্য সেবাকার্যে যুক্ত ব্যক্তি অকস্মাৎ স্বার্থসর্বস্ব প্রকল্প গ্রহণ করিতে পারেন। তাহাতে অন্য লোকের মুগ্ধতায় চিড় ধরিতে পারে, কিন্তু তাহাতে কি পূর্বের ব্যক্তিটি মুছিয়া যায়? বর্তমানের ব্যক্তিটি কি অতীত ব্যক্তিটির তুলনায় সততই গুরুত্বপূর্ণ? মানুষ সর্বদা প্রত্যাশিত ব্যবহারের অনুবর্তী হয় না, ইহা তাহার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। পুরস্কার প্রদানের সময় এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্মৃত হইয়া তাহা করা হয়, ভাবিবার কারণ নাই।

অন্য দিকে, কেহ বলিতে পারেন, পুরস্কার তো ব্যক্তিটিকেই দেওয়া হয়। তিনি যদি সহসা তাঁহার এতাবৎকাল কৃত কাজের বিপরীত কাজ করিতে শুরু করেন, তবে পুরস্কারটি মূল্যহীন হইয়া পড়ে। কেবল তাহাই নহে, বর্তমান কার্যের লজ্জায় বরং প্রদত্ত সম্মানটির অসামঞ্জস্য প্রকটতর হইয়া উঠে। যদি ধরিয়া লওয়া হয়, ব্যক্তি বদলাইতেই পারেন, তবে তর্ক হইবে, পুরস্কারটি প্রাক্-বদল ব্যক্তিটিকে দেওয়া হইয়াছিল, বর্তমান ব্যক্তিটির সেই পুরস্কারে অধিকার নাই। ব্যক্তির সহিত বিখ্যাত পুরস্কার যেমন জড়াইয়া থাকে, পুরস্কারের সহিতও বিখ্যাত ব্যক্তির নাম জড়াইয়া থাকে। যদি খ্যাত ব্যক্তি এমন কাজ শুরু করেন, যাহা পুরস্কারটির সত্তার বিরুদ্ধে যায়, তাহাতে পুরস্কারেরও অপমান। ব্যক্তিটিকে ধিক্কার দিবার সময় বারংবার পুরস্কারটির প্রসঙ্গ উঠিবে, ইহাতে পুরস্কারটির ভবিষ্যৎ-সমাদরও কমিয়া যাইতে পারে। সাহিত্যের পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ ভিন্ন, কিন্তু মানবাধিকারের ন্যায় স্পর্শকাতর বিষয়ে ঔচিত্য ও স্বীকৃতির সম্পর্ক অধিক প্রত্যক্ষ। তর্কটি জটিল, বহুস্তর, প্রাসঙ্গিক, সুতরাং তাৎপর্যপূর্ণ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন