—ফাইল চিত্র।
সঙ্কটকাল এক ঘনিয়ে উঠছে যেন নরেন্দ্র মোদীদের সামনে। প্রায় চার বছর কাটিয়ে ফেলেছেন মোদী দিল্লির মসনদে। মসৃণই এগিয়েছে সব কিছু। কিন্তু গত কয়েক মাসে একটু একটু করে বদলাতে বদলাতে মসৃণতা উধাও। পথ কুসুমাস্তীর্ণ আর নয়। নরেন্দ্র মোদীদের ঘিরে তথা বিজেপি-কে ঘিরে নানান সঙ্কট যেন ব্যূহ রচনা করেছে আজ।
দক্ষিণী শরিক চন্দ্রবাবু নায়ডুর দল তেলুগু দেশম পার্টি কয়েক দিন আগেই ছে়ড়ে দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা। এ বার সে দল নরেন্দ্র মোদীর জোটও ছেড়ে দিল।
সঙ্কট শুধু তেলুগু দেশম নয়। সঙ্কট ঘনাচ্ছে আরও নানা প্রান্ত থেকে। শরিকি বিবাদে অসন্তোষ আজ শিবসেনারও। বিজেপির সবচেয়ে পুরনো জো়টসঙ্গী শিবসেনা দু’বেলা সরকার তথা এনডিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। বিহারের সঙ্গী জেডি(ইউ) জানিয়ে দিয়েছে, বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি এ বার গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই হবে। গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে স্থানীয় স্তরের একের পর এক নির্বাচনে বিজেপির হার হচ্ছে। প্রথমে গুজরাতের ভোটে এবং তার পরে মহারাষ্ট্রের কৃষক আন্দোলনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, মোদীর রাজত্বে খুশিতে নেই গ্রামীণ ভারত। গ্রামের দুর্দশা এবং অসন্তোষ উদ্বেগজনক চেহারা নিচ্ছে। একসঙ্গে এতগুলো সঙ্কটের মোকাবিলা যে করতে হতে পারে নরেন্দ্র মোদীকে, ছ’মাস বা এক বছর আগেও তেমনটা কেউ আঁচ করেননি।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
রাজনীতিতে চড়াই-উতরাই আসতেই থাকে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের যাত্রাপথও মসৃণ থাকে না সর্বদা। সঙ্কট সকলের সামনেই আসে। বড় নেতারা সঙ্কট কাটিয়েও ওঠেন। অনেকগুলো সমস্যা একসঙ্গে ঘিরে ধরেছে আজ মোদীকে— ঠিক সে কথা। কিন্তু মোদী কি খুব দ্রুত এই সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন? এ প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ প্রশ্নের খুব স্পষ্ট এবং যৌক্তিক জবাব বিজেপির তরফ থেকে মিলছে না।
ভারতীয় রাজনীতি কিন্তু এই মুহূর্তে এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে। কৃষিজীবী ভারত তথা গ্রামীণ ভারত নানা সূচকের মাধ্যমে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সে খুশি নয়। গ্রামীণ মহারাষ্ট্র থেকে হেঁটে আসা ক্ষতবিক্ষত এক পদযুগল আজ নগর মুম্বইয়ের সেবা পাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত ভঙ্গিতে আজ অখিলেশ যাদব আর মায়াবতীর মধ্যে জোট হয়ে যাচ্ছে। ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙা হলে সিপিএমের পাশে দাঁড়িয়ে আজ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— এমন অসম্ভব এক দৃশ্যকল্প বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। প্রধান বিরোধী কংগ্রেস এবং এনডিএ বহির্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজ্য দল এক ছাতার তলায় আসার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে নিজের নিজের তাগিদেই। ফলে শাসকের সঙ্কটমুক্তি খুব সহজে হবে, এমনটা ধরে নেওয়া যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
অসন্তুষ্ট সব শরিকই চন্দ্রগ্রহণে ছায়া পদ্মে
সঙ্ঘ পরিবার চক্রব্যূহ তত্ত্বের অবতারণা করেছে ইতিমধ্যেই। মহাভারতে অভিমন্যুকে যেমন চক্রব্যূহে ঘিরে ফেলেছিল শত্রুপক্ষ, তেমনই ঘিরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে মোদীকে— এমন কথা শোনা যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী সত্যিই অভিমন্যু অর্থাৎ শুভশক্তির প্রতিভূ কি না, তাঁকে যাঁরা ঘিরে ফেলছেন, তাঁরা সত্যিই কৌরবদের মতো কি না, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। সে বিতর্কের ফয়সলাও নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু তার আগে সকলেই দেখতে চান, নরেন্দ্র মোদী এই ‘চক্রব্যূহ’ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারেন কি না।
ভারতীয় গণতন্ত্র কিন্তু বেশ পরিণত গণতন্ত্র। সাত দশকের ইতিহাসে অনেক বার নিজের পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিয়েছে সে। নরেন্দ্র মোদীরা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না, ভবিষ্যৎ সে উত্তর দেবে, ইতিহাস তার সাক্ষী থাকবে ভবিষ্যতে। কিন্তু এই মুহূর্তে ইতিহাস জানান দিচ্ছে, শুধু কথায় ভোলানো যায় না ভারতীয় গণতন্ত্রকে, শুধু 'ইন্ডিয়া শাইনিং' বলে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিলেই ভারতবাসী তা বিশ্বাস করেন না, 'ইন্ডিয়া' যে 'শাইনিং', তা প্রমাণ করার দায়ও শাসকের থাকে এবং মোদীর নিজের দলই সে সত্য সবচেয়ে ভাল ভাবে উপলব্ধি করেছিল ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে।
নরেন্দ্র মোদীরা সঙ্কটের মোকাবিলা করে ফের বিরোধী পক্ষকে ধরাশায়ী করতে পারবেন কি না, সে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী না করাই শ্রেয়। কিন্তু ভারত যে এগিয়েছে গত চার বছরে, ভারতবাসীর জীবন যে সহজ হয়েছে এই জমানায়, তার অকাট্য প্রমাণ না দিতে পারলে যে বিজেপির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয় তা এখনই বলে দেওয়া যায়।