ফাইল চিত্র।
দুন্দুভি নিনাদটা এত তাড়াতাড়ি শোনা যাবে, তা আশা করা যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দিল্লি সফর যে রাজনৈতিক, তা জানা ছিল। রাজনৈতিক সফরে রাজধানীতে গিয়ে যে তৃণমূল নেত্রী অ-বিজেপি ঐক্য গড়ার চেষ্টা করবেন, তাও জানা ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের দামামা মমতার এই দিল্লি সফরেই কার্যত বেজে উঠবে, তা অনেকেই আঁচ করেননি।
একের বিরুদ্ধে এক— খুব সুনির্দিষ্ট করে লক্ষ্যটা ঘোষণা করে দিলেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। আগামী লোকসভা নির্বাচনে দেশের প্রতিটি কেন্দ্রে বা অধিকাংশ কেন্দ্রে বা যত বেশি সম্ভব কেন্দ্রে একদিকে থাকবেন বিজেপির প্রার্থী, অন্যদিকে থাকবেন সম্মিলিত বিরোধী পক্ষের একজন প্রার্থী। অর্থাৎ বিজেপি এক, বিপরীতে অ-বিজেপি-ও এক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবনা এই রকমই।
উত্তরপ্রদেশে সম্প্রতি দু’টি লোকসভা কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন হয়েছে। গোরক্ষপুর এবং ফুলপুর— দু’টি আসনই আগে বিজেপির দখলে ছিল। উপ-নির্বাচনে বিজেপি-কে হারাতে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে বহুজন সমাজপার্টির সর্বময়ী নেত্রী মায়াবতী সামনে এসেছিলেন। নিজে প্রার্থী না দিয়ে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন। তাতে অবশ্য একের বিরুদ্ধে এক নীতির পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণ সম্ভব হয়নি। কারণ, কংগ্রেস শরিক হয়নি মায়াবতী-অখিলেশদের সমঝোতার। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস আপাতত প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হওয়ায় গোরক্ষপুর এবং ফুলপুরে লড়াই প্রায় একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতেই পৌঁছে গিয়েছিল। তাতে বিজেপির পরাজয় ঘটেছে। অর্থাৎ প্রায় একের বিরুদ্ধে এক হলেই হেরে যাচ্ছে বিজেপি। পুরোপুরি একের বিরুদ্ধে এক হলে, কী রকম হবে ছবিটা তা হলে?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
উত্তরপ্রদেশের দুই লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন মেটার পর থেকেই বিরোধী শিবিরে একের বিরুদ্ধে এক নীতি নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দিল্লিতে পা রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে তুলে ধরলেন সে প্রস্তাবনা, ততটা সুনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে এতদিন সামনে আসেনি অ-বিজেপি দলগুলির সার্বিক নির্বাচনী সমঝোতার কথা। সরাসরি আসন সমঝোতার স্তরে আলোচনাটাকে পৌঁছে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
আরও পড়ুন: আপাতত সব দরজা খোলা, জল মাপছেন মমতা
বিরোধী শিবিরের ঐক্য বা অ-বিজেপি ঐক্যের চেহারাটা ২০১৯ সালে কেমন হবে, তা নিয়ে নানা রকম প্রস্তাবনা রয়েছে। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস চাইছে কংগ্রেসের নেতৃত্বেই বিরোধী দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হোক, ইউপিএ-৩ গঠিত হোক। শরদ পওয়ার, ফারুক আবদু্ল্লা, করুণানিধি, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, লালুপ্রসাদ যাবদদের মতো আঞ্চলিক মহারথীরাও চাইছেন, জোটের নেতৃত্ব রাহুল গাঁধীর হাতেই থাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার চাইছেন, জোট হোক কংগ্রেসকে বাদ রেখে। কিন্তু কংগ্রেস সে জোটকে সমর্থন করুক। নবীন পট্টনায়ক, ইয়েচুরি-কারাট, চন্দ্রবাবু নায়ডু, পনীরসেলভম-পলানীস্বামী, উদ্ধব ঠাকরেদের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। অতএব সমঝোতা কোন পথে এগোবে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট দিশা ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী ঐক্যের সম্ভাবনাকে সুনির্দিষ্ট দিশাটাই দেখিয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন: নেতৃত্বে আমরাই, মমতাকে সনিয়া
বিরোধী জোটের নেতৃত্বে কংগ্রেস থাক, এমনটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন না। কিন্তু কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে যে বিজেপি বিরোধী জোট সফল হতে পারে না এবং সে রাজনৈতিক বাস্তবতা যে তাঁর অজানা নয়, তাও মমতা বুঝিয়ে দিলেন। সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক সারলেন। বৈঠক সেরে বেরিয়েই জানিয়ে দিলেন— ফর্মুলা একের বিরুদ্ধে এক। অর্থাৎ, বিরোধী জোটের চেহারা যেমনই দাঁড়াক, সমঝোতাকে টাল খেতে দেওয়া চলবে না। যে দল যেখানে শক্তিশালী, সে দলই সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে। বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ হতে দিলে চলবে না। এই প্রস্তাবনা কিন্তু খুব অবাস্তব নয়। বিরোধীদের মধ্যে সার্বিক জোট হোক বা না হোক, পরস্পরকে আসন ছেড়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ যে করাই যায়, তা মনে করিয়ে দিলেন মমতা। আলোচনা যেখানে জোটের চেহারায় আটকে গিয়েছিল, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে আসন সমঝোতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলেন ঐক্যের প্রক্রিয়াকে। বিরোধী দলগুলির মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে কথা শুরু হয়ে যাওয়া নির্বাচনের দুন্দুভি নিনাদ ছাড়া আর কী?
কাজটা অতএব কঠিন হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের জন্য। বিরোধী পক্ষ জোট বাঁধলে বিজেপির পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াতে পারে, উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনে তার আভাস কিছুটা মিলেছে তো বটেই। ২০১৯-র নির্বাচনের আগে ঘরটা গুছিয়ে নেওয়া অতএব খুব জরুরি ছিল বিজেপির জন্য। শাসকদল ঘর গুছিয়ে নেওয়ার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের দামামাটা বাজিয়ে দিলেন। এই দুন্দুভি নিনাদ কিন্তু বিজেপির জন্য অশনিসঙ্কেত। সে কথা নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা বুঝছেন নিশ্চয়ই। যদি বুঝে থাকেন, তা হলে কিন্তু নিজেদের ঘরটা গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তাঁদেরই নিতে হবে। সে কাজ কিন্তু অবিলম্বে শুরু করা দরকার। না হলে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পথটা বিজেপির জন্য খুব মসৃণ কিন্তু হবে না।