শালবনে ভালুকের ভয়, একা চলেছেন বিভূতিভূষণ

ঝাড়গ্রামের সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবিড় যোগ ছিল। ঘুরে বেড়াতেন পুরনো ঝাড়গ্রামের শাল, কেঁদ গাছে ভরা রাস্তায়। একাকী মুগ্ধতায়। লিখলেন মৃন্ময় হোতাবিভূতিভূষণের দিনলিপিতে স্থান পাওয়া জায়গাটা রাজবাড়ির পাশে, পুরনো ঝাড়গ্রাম। স্টেশনের কাছে হয়েছে নতুন বসত। কলকাতার অনেক ভদ্রলোক বাড়ি করেছেন সেখানে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০২:০৫
Share:

পথ: খানাকুইয়ের এই এলাকার বর্ণনা দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। নিজস্ব চিত্র

প্রকৃতি মুগ্ধ লেখক। থাকতেন ঘাটশিলায়। ঝাড়গ্রামের সঙ্গে কি কোনও যোগ ছিল না বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের? অরণ্যশহর নামে পরিচিত ঝাড়গ্রাম। তার প্রকৃতি কি টানেনি ‘পথের কবি’কে? উত্তর মেলে ‘বনেপাহাড়ে’। বিভূতিভূষণের দিনলিপি। কী লিখছেন দিনলিপিতে? ‘সেদিন ছিল অষ্টমী তিথি। সন্ধ্যার পরেই চমৎকার জ্যোৎস্না উঠলো। ঝাড়গ্রামে আমার এক আত্মীয় বাড়ীতে গিয়ে দিন দুই আছি– হঠাৎ ইচ্ছে হলো এমন জ্যোৎস্নায় একটুখানি বেড়িয়ে আসি’।

Advertisement

বিভূতিভূষণের দিনলিপিতে স্থান পাওয়া জায়গাটা রাজবাড়ির পাশে, পুরনো ঝাড়গ্রাম। স্টেশনের কাছে হয়েছে নতুন বসত। কলকাতার অনেক ভদ্রলোক বাড়ি করেছেন সেখানে। কিন্তু পুরনো ঝাড়গ্রামের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্য মুগ্ধতা দিনিলিপিতেও। ‘সাবিত্রী-মন্দিরের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেল গ্রামের বাইরে মাঠ ও বনের দিকে। একাই চলেছি, শালবনে কচি পাতা গজিয়েছে, কুসুম গাছের রঙিন কচি পাতার সম্ভার দূর থেকে ফুল বলে ভুল হয়। গ্রাম ছাড়িয়ে পায়ে-চলা মাঠের পথ শালবনের মধ্যে দিয়ে দূর থেকে দূরান্তরে অদৃশ্য হয়েছে-সুঁড়ি পথের দু’ধারে শালবন।...এ পথে কখনও আসিনি, কোথায় কি আছে জানি নে। ভালুক বেরুবে না তো? শুকনো শালপাতার ওপরে খস্‌খস্‌ শব্দ হোলেই ভাবছি এইবার বোধহয় ভালুকের দর্শনলাভ ঘটল। আরো এগিয়ে চলেছি–একটা ছোট পাহাড়ী নদী ঝির্‌ঝির্‌ করে বয়ে চলেছে পথের ওপর দিয়ে। হাঁটুখানেক জল, এমনি পার হয়ে ওপারের পাড়ে উঠলাম–উঁচু কাঁকর মাটির পাড়। শহর থেকে প্রায় দেড় মাইল চলে এসেছি। জ্যোৎস্নাস্নাত উদার বন-প্রান্তর আমার সামনে। ফিরবার ইচ্ছে নেই...’।

প্রকৃতির টানে সেদিন কোথায় গিয়েছিলেন লেখক? উনি এসেছিলেন খানাকুই গ্রামে এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে। কিন্তু কবে ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন? এর উল্লেখ দিনলিপিতে নেই। অনেক পরে সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপিতে এর উত্তর মেলে। ১৯১০ সালে কলকাতা থেকে কালিমাটি (এখনকার টাটানগর) পর্যন্ত রেললাইন পাতা হল। ঝাড়গ্রামের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ অনেকটাই সহজ হয়। তখনকার পশ্চিমে যাওয়া চেঞ্জারবাবুদের কাছে গিরিডি, মধুপুর, দেওঘর, শিমূলতলার সঙ্গে যুক্ত হয় ঝাড়গ্রাম, গিধনি, ঘাটশিলা, গালুডি। সেখানের জলবায়ু ও পরিবেশ যে এতটা মনোরম তা রেল সংযোগ না হলে অনেকেই জানতে পারতেন না। কারণ ‘বম্বে রোড’ দিয়ে মোটর চলাচলের পথ তখনও সুগম হয়নি। ওই রেলপথ ছিল বিএনআর অর্থাৎ বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে।

Advertisement

বিএনআর-পথে বিভূতিভূষণ প্রথমবার আসেন ১৯৩৩ সালের ৩ মার্চ। উদ্দেশ্য বন্ধুদের সঙ্গে ঝাড়সুগদার কাছে বিক্রমখোল শিলালিপি দেখা। প্রথম দেখাতেই পথের সৌন্দর্যে বিভোর। বিশেষত খড়গপুর পেরনোর পর প্রাকৃতিক পরিবেশের আমূল পরিবর্তন, দিগন্ত বিস্তৃত শালবন, ল্যাটেরাইটের টিলা, তাঁর ভাল লেগে যায়। জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল বিভূতিভূষণের দিনলিপি ‘তৃণাঙ্কুর’। তিনি লিখেছেন, ‘সেই খড়্গপুর থেকে আরম্ভ হয়েছে রাঙামাটি, পাহাড় ও শালবন–আর বরাবর চলেছে চারশ মাইল... খড়গপুরের ওদিকে কলাইকুন্ডা জায়গাটা ঐ হিসেবে বেশ ভাল’। আবার ৬ মার্চ বিক্রমখোল শিলালিপি দেখে ফেরার সময় ডায়েরিতে লিখছেন, ‘কোলকাতার কাছে গিডনী (গিধনি) বেশ জায়গা। অতি সুন্দর জলাশয়। বাজার–মুক্ত মাঠ শালবন। অনেক বাঙালী Changer রা থাকে’।

১৯৩৩ সালের পুজোর সময় বিএনআর-এর টানে আবার বন্ধুদের সঙ্গে গেলেন নাগপুরে। ২৩ সেপ্টেম্বরে ডায়েরিতে লিখলেন, ‘গাড়ী ছাড়ল। বম্বে মেলে ওদের লাইনে–ভারী খারাপ। গিডনি স্টেশনে জনকতক Changer নেমে গেল। রাত গভীর হয়ে এল। আহারাদি শেষ করে upper birth এ গিয়ে শুলাম। কিন্তু ঘুম আসে না’। আসলে তাঁর মন কিছু দেখার প্রতীক্ষায় থাকলে তাঁর ঘুম আসত না। এমনকি রাতের অন্ধকারেও ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরের শোভা উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন। কোনও স্টেশনে গাড়ি থামলে ডায়েরিতে তার নাম ও জায়গাটির প্রকৃতির বর্ণনা সংক্ষিপ্ত লিখে রাখতেন। এভাবেই তাঁর ডায়েরিতে ঝাড়গ্রামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৩৩ সালের ৭ অক্টোবর। নাগপুর থেকে ফিরছেন। লিখছেন, ‘তারপর শেষরাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি জ্যোৎস্না ফুটেছে চারিধারে–গাড়ি এসেছে ঝাড়গ্রামে’।

‘পথের পাঁচালী’র লেখক কলকাতায় সুযোগ পেলেই শোনাতেন বিএনআর-এর পথের কথা। এরপর মামিমার হাওয়া বদলের প্রয়োজন পড়লে গালুডিতে বাসা ঠিক করে মামাবাড়ির লোকজনদের পাঠিয়ে দিয়ে ভাই নুটুবিহারীকে সঙ্গে নিয়ে নিজে আসেন ১৯৩৪ সালের ২৬ জানুয়ারি। থাকেন ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি সেখানকার উচ্চতম পাহাড় সিদ্ধেশ্বর ডুংরি ওঠার সময় মাথায় আসে ‘আরণ্যক’ লেখার প্লট। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘A novel on forest–ওতে নির্জ্জনতার কথা থাকবে।...কেঁদ। আমলকী। বিরাট দৃশ্য। বিরাট জাতি। টাঁড়বারো। ভালুক ঝোড়। ও রামগড় ও রানী ঝর্ণা’। এই ‘রানী ঝর্ণা’ই ‘আরণ্যক’এর সেই ঝরনা। যদিও ‘আরণ্যক’ লিখেছিলেন অনেক বছর পরে।

তার পর কলকাতায় ফিরলেন। কিন্তু কাজে মন বসে না। বিএনআর-এর টানে আবার বন্ধুদের সঙ্গে এপ্রিল ও অক্টোবরে যান রাখামাইনসে। ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হওয়ায় তখন তিনি বিখ্যাত। ডাক আসে বহু জায়গা থেকে। ঘাটশিলায় কেনা হয় একটা ছোট্ট বাড়ি। নাম রাখেন গৌরীকুঞ্জ। ঝাড়গ্রামে সে সময় সেরকম কোনও সাহিত্যগোষ্ঠী না থাকায় তাঁর ডাক আসেনি। কিন্তু তাঁর ‘বনেপাহাড়ে’ এবং ‘হে অরণ্য কথা কও’এর শুরুতেই আছে ঝাড়গ্রামের কথা। বিভূতিভূষণ ‘বনেপাহাড়ে’ শুরু করছেন, ‘সিংভূম জেলার পাহাড় জঙ্গলের কথা ছেড়ে দিই–বাংলাদেশের প্রত্যন্ত সীমায় অবস্থিত মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার অনেক স্থান জনহীন ও অরণ্যসঙ্কুল থাকার দরুণ ‘ঝাড়খণ্ড’ বা বনময় দেশ বলে অভিহিত হোত। ওই দেশের মধ্যে দিয়ে ছিল পুরী যাওয়ার রাস্তা। মেদিনীপুর জেলার বর্তমান ঝাড়গ্রাম মহকুমার মধ্যে দিয়ে এই পুরোনো পথ এখনও বর্তমান আছে। শ্রীচৈতন্য সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এই পথে একদিন পুরী গিয়েছিলেন।...ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ীর সামনে দিয়ে এই পথ আজও আছে, রাজবাড়ীর থেকে পাঁচ মাইল কিংবা তার কিছু বেশি গেলেই বম্বে রোডের সঙ্গে এই রাস্তা মিশে গিয়েছে’।

এরপর কৌতুকপ্রিয় বিভূতিভূষণ লিখছেন ‘এই রাস্তার নাম কেন যে বম্বে রোড বলা হয় তা জানিনে– কারণ বম্বের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক চর্মচক্ষে আবিষ্কার করা যায় না। তবে যদি কেউ বলে, এ রাস্তা দিয়ে কি মশাই বম্বে যাওয়া যায় না? আমায় বলতে হবে বিশেষ করে বম্বে যাবার জন্য এ রাস্তা নয়। ময়ুরভঞ্জের মধ্যে দিয়ে এ রাস্তা সোজা চলে গেল সমুদ্রতীরের দিকে। তবে এ রাস্তা থেকে অন্য একটা রাস্তা বেরিয়েছে ময়ুরভঞ্জের বাঙ্গিপোস (বাংরিপোস) নামক যায়গায়। সে রাস্তায় বেঁকে গেলে কি হয় বলা যায় না– হয়তো বম্বে যাওয়া যেতে পারে, সে রকম দেখতে গেলে তো যে কোন রাস্তা দিয়েই বম্বে যাওয়া যায়। যে কোন জেলার যে কোন রাস্তাকে তবে বম্বে রোড বলা হবে না কেন’?

লেখক শিক্ষক ও গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন