Editorial News

ইতিহাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা!

কোথায় এসে দাঁড়ালাম তা হলে আমরা? আমরা আরও বড় ক্ষতস্থানের মুখোমুখি হলাম। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভেঙে সম্প্রীতির দেওয়ালে বৃহৎ ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছিল। এ বার ঐতিহাসিক উপলব্ধিকে অস্বীকার করে খোদ ইতিহাসের বুনটটায় বড়সড় ক্ষতস্থান তৈরির চেষ্টা শুরু হয়ে গেল।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৬
Share:

ছবি: সংগৃহীত।

ইতিহাস এক বহমান নদীর মতো। কালের অনন্ত বিস্তার বেয়ে নেমে আসছে সে প্রবাহ। সভ্যতার বিবর্তন, সংস্কৃতির স্ফূরণ, দেশ-জাতি-জনগোষ্ঠী-ধর্ম-সম্প্রদায়কে কাঁধে নিয়ে মানবতার নিরন্তর যাত্রা— এই সব কিছুরই সাক্ষী ইতিহাস। মানব সভ্যতার যাত্রাপথের প্রত্যেকটি বাঁক, প্রতিটি মাইলফলকের হিসাবরক্ষক ইতিহাস। সেই ইতিহাসকেই যখন বদলে দেওয়ার চেষ্টা হয়, রাজনীতির প্রবাহে মোড় আনতে যখন ইতিহাসের সর্বজনবিদিত যাত্রাপথটাকে অন্য ভাবে দেখানোর চেষ্টা হয়, তখন আসলে কালের সঙ্গেই প্রতারণা করা হয়। এই প্রতারণা দুর্ভাগ্যজনক তো বটেই, বিপজ্জনকও।

Advertisement

বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার সঙ্গে মুসলিম বিরোধিতার কোনও সম্পর্ক নেই— এমন এক তত্ত্বের অবতারণা করা হল এ বার সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষ থেকে। বাবরি আসলে ‘গোলামি’র প্রতীক, বাবরি আসলে ‘অত্যাচার’-এর প্রতীক, সেই কারণেই পতন ঘটানো হয়েছিল ওই কাঠামোর— রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক নেতা এমন এক নতুন তত্ত্ব সামনে আনলেন। সে তত্ত্বের সমর্থনে গোটা সঙ্ঘ পরিবারের আরও অনেকেই মুখ খুললেন।

কোথায় এসে দাঁড়ালাম তা হলে আমরা? আমরা আরও বড় ক্ষতস্থানের মুখোমুখি হলাম। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভেঙে সম্প্রীতির দেওয়ালে বৃহৎ ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছিল। এ বার ঐতিহাসিক উপলব্ধিকে অস্বীকার করে খোদ ইতিহাসের বুনটটায় বড়সড় ক্ষতস্থান তৈরির চেষ্টা শুরু হয়ে গেল।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

বাবরি মসজিদ সম্পর্কে সঙ্ঘের সুরেশ ভাইয়াজি জোশীর মন্তব্য বা সে মন্তব্যের প্রতি বিজেপির কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের অকুণ্ঠ সমর্থন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিন্তু নয়। ইতিহাস বদলে দেওয়ার এক সংগঠিত প্রয়াসের অঙ্গ এ। শুধু বাবরি মসজিদ সম্পর্কে এই রকম মন্তব্য হয়েছে, তা কিন্তু নয়। কখনও তাজমহলকে অত্যাচার, শোষণ ও গোলামির প্রতীক বলা হচ্ছে। কখনও টিপু সুলতান সম্পর্কে চরম অবমাননাকর তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে। কখনও দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের মতো সৌধকে ঔপনিবেশিকতার প্রতীক বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের ইতিহাসকে, ভারতীয় রাজনীতির প্রবাহকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে শতকের পর শতক ধরে দেখে আসছি আমরা, সেই দৃষ্টিকোণটাই বদলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে ইতিহাসের উপর সুসংগঠিত আক্রমণ ছাড়া আর কোনও নামেই ডাকা যেতে পারে না।

আরও পড়ুন
বাবরি ভাঙার নয়া তত্ত্বে সঙ্ঘ

বামিয়ানে পর্বতগাত্রে খোদিত সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি যখন কামান দেগে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল তালিবান, গোটা বিশ্ব তখন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার আধারভূমি হিসেবে পরিচিত যে মধ্য এশিয়া, ধর্মোন্মাদ, খুনি, ইসলামিক স্টেটের হাতে সেই মধ্য এশিয়ায় একের পর এক অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস হয়েছে। গোটা বিশ্ব নিন্দায় সরব হয়েছে। যাঁরা বাবরি ভেঙেছিলেন, ইরাকে বা বামিয়ানে বর্বরতার বিরুদ্ধে তাঁরাও কিন্তু মুখর হয়েছিলেন। এই মুখরতা সঙ্গত, বর্বরতার বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রতিবাদ স্বাগত। কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাও যে অন্যায়, সে কথা যেন আজ অনেকেরই মনে নেই। ইতিহাস বিস্মৃত হওয়া খুব সহজ। কিন্তু তার ফলাফল ভোগ করা ততটাই কঠিন, এ কথা মাথায় রাখা উচিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন