সম্পর্কের বিড়ম্বনা

ধুনিক বাংলার আর এক বৈশিষ্ট্য, নয়া রেনেসাঁস: যিনি কবি তিনিই নাট্যকার, যিনি চলচ্চিত্রকার তিনিই গায়ক। কিন্তু সেই সুবাদে তো এক জনের বাড়ি আলাদা আলাদা করিয়া চার-পাঁচ বার যাওয়া যায় না!

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ০০:১৬
Share:

অমিত শাহ।

বিজেপির নয়া পরিকল্পনা, দলের নেতাগণ খ্যাতনামা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহিত দেখা করিবেন এবং সরকার সম্পর্কে আলোচনা করিবেন। এক এক জন নেতাকে ২৫ জন খ্যাত ব্যক্তি বা সেলেব্রিটি-র সহিত দেখা করিতে হইবে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এই ‘সম্পর্ক ফর সমর্থন’ প্রকল্পের কী দশা হইবে কেহ জানে না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অত জন বিখ্যাত ব্যক্তি তো নাই। শুনা যায়, এক শিশু অটোগ্রাফের খাতা হস্তে জলসায় ঘুরিয়া বেড়াইত এবং যাহাকেই পাইত জিজ্ঞাসা করিত, ‘‘আপনি কি কেউ? আপনি কি কেউ?’’ বিজেপি নেতাগণের সেই পরশপাথর-সন্ধানী খ্যাপার অবস্থা হইয়াছে। তাঁহারা ‘কেউ’ পাইবেন কোথায়, বাংলার সিনেমা-সিরিয়ালের তারকাগণের অধিকাংশকেই তৃণমূল অতি পূর্বে ট্যাঁকে পুরিয়া ফেলিয়াছে। অবশিষ্ট যাঁহারা, কবি নাট্যকার সাহিত্যিক, তাঁহাদের মধ্যে খ্যাতদের এক হাতের আঙুলে গুনিয়া ফেলা যাইবে। আধুনিক বাংলার আর এক বৈশিষ্ট্য, নয়া রেনেসাঁস: যিনি কবি তিনিই নাট্যকার, যিনি চলচ্চিত্রকার তিনিই গায়ক। কিন্তু সেই সুবাদে তো এক জনের বাড়ি আলাদা আলাদা করিয়া চার-পাঁচ বার যাওয়া যায় না! আজ চিত্রকর সত্তার সহিত দেখা করিলাম, কাল দার্শনিক সত্তার সহিত! তাহা হইলে এত জন নেতা তাঁহাদের কোটা পূরণ করিবেন কেমন করিয়া? না করিলে আবার অমিত শাহ রাগিয়া যাইবেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের একমাত্র উপায়, সত্বর সেলেব্রিটি উৎপাদন।

Advertisement

তাহা খুব কঠিন নহে। ইহার জন্য হাতে থাকিতে হয় কিছু মঞ্চ, কিছু দুন্দুভি। বিজেপি যদি যদু মধু কাহাকেও ঠেলিয়া বেদিতে তুলিয়া সহসা ঢেঁড়া পিটাইয়া প্রচার শুরু করিয়া দেয়: ইঁহার ন্যায় সুলেখক নাই, উঁহার ন্যায় সুগায়ক হয় না— এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই ধারণাগুলি জনতার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করিয়া ফেলা সম্ভব। কেবল কিছু পেটোয়া মানুষকে বারংবার সেই অর্বাচীনদের কীর্তি দেখিয়া ‘আহা! বাহা!’ করিয়া উঠিতে হইবে ও সান্ধ্য আসরে সেইগুলি বারংবার প্রদর্শন করিতে হইবে। সম্পূর্ণ অখ্যাত ব্যক্তিকে দেখিয়া সোমবার পথচারী দর্শক শ্রোতা জিজ্ঞাসা করিবেন, ‘‘এ আবার কে?’’ বৃহস্পতি নাগাদ ভাবিবেন, ‘‘ইঁহাকে লইয়া এমন হইহই হইতেছে যখন, নির্ঘাত বড় কেহই হইবেন’’, এবং পরের সোমবার তিনি এই তারকার মহা অনুরক্ত হইয়া পড়িবেন, কারণ পাদপ্রদীপের আলোকে যাঁহাকে মুহুর্মুহু দেখা যায়, তাঁহার ভক্ত হইয়া পড়াই নিয়ম। খ্যাত ব্যক্তিকে লইয়া হইচই ঘটে— এই স্বতঃসিদ্ধকে ‘‘যাঁহাকে লইয়া হইচই ঘটে, তিনিই খ্যাত’’-তে ঘুরাইয়া লইয়া অনেকেই পসার বাড়াইতেছেন এবং বিজেপিও এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বহু বিশিষ্ট জন ‘নির্মাণ’ করিয়া, তাঁহাদের সহিত চটপট দেখা করিয়া লইতে পারেন। আর তাঁহাদের মুখ হইতে বিজেপি সরকারের ভূয়সী প্রশস্তি আদায় তো সহজ বিনিময়-শর্ত।

অন্যকে বিশিষ্ট জন বানানো যাইলে, নিজেকে বানাইতেই বা বাধা কী? চার পাঁচ লাইন পদ্য লিখিয়া দেশপ্রেম, বিশেষত হিন্দুত্বের জয়গান করিলে, তাহার প্রশংসা করিবে না, এমন পাষণ্ড কে আছে? পার্টির অনুগতদের ধরিয়া পাকিস্তানবিরোধী চতুর্দশপদী পড়িয়া শুনাইলে বা গোহত্যা-নিবারণী জীবনমুখী গাহিলে প্রকাণ্ড সমাদর হইবে, সন্দেহ নাই। এই ভাবে নিজেই ক্রমে এক বিশিষ্ট জন বনিয়া যাইলে, সম্পর্ক করিতে হইবে ২৪ জনের সহিত, কারণ নিজের সহিত তো সম্পর্ক রহিয়াছেই। নেতা পিছু এক জন কমিলে, কম সুবিধা? আরও কিছু কৌশল গ্রহণ করা যায়। বিজেপি ভারতের পৌরাণিক যুগ লইয়া উচ্ছ্বসিত। কোনও এক ধূলিমলিন শাস্ত্রগ্রন্থের বিস্মৃতপ্রায় সংস্কৃত শ্লোক কি সহসা উদ্ধার করা যায় না, যাহা উচ্চারণ করিয়া অতীতের বিশিষ্ট জনকে মিনিট পাঁচেকের জন্য মর্তে নামাইয়া আনা সম্ভব? রবীন্দ্রনাথের সহিত মুকুল রায়ের আলোচনার ছবি ছাপিতে পারিলে, তাহার তো মার নাই! এই রাজ্যের বাঙালিরা সচরাচর যাঁহাদের পূজার্চনা করে, তাঁহাদের কাহারও শতবর্ষ, কাহারও সার্ধশতবর্ষ চলিতেছে। তাঁহাদের সহিত দেখা করিলে, অনায়াসে কেল্লা ফতে। উত্তমকুমার বা সত্যজিৎ রায়ের সহিত বিজেপি নেতার কথাবার্তার বিবরণ নিশ্চিত ভাবেই আধুনিক বিখ্যাত মানুষের সহিত আলোচনার তুলনায় বহু গুণ গ্ল্যামারদীপ্ত। ঠিকই, এই সকল বাক্যালাপের ছবি দেখিয়া অসৎ নিন্দুকেরা চেঁচাইতে পারে— ফটোশপ করা হইয়াছে, কিন্তু সে তো নিন্দুকেরা গণেশের প্লাস্টিক সার্জারিতেও বিশ্বাস করে না!

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

আইনস্টাইন ডায়রিতে লিখেছিলেন, প্রচণ্ড গরমের ফলে ভারতীয়দের বুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীর নিন্দেমন্দ চলেছে। কিন্তু যে গরমটা পড়েছে, সত্যিই ঘিলু ভেস্তিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় বেরোলেই সব্বার মেজাজ খিঁচড়ে ভয়ানক, আর গনগনে ক্রোধ তো বুদ্ধিপ্রয়োগের শত্তুর! কেউ গরম থেকে বাঁচতে মাথামুখে তেরো স্তর কাপড় জড়িয়ে নিজেকে ই.টি. বা চম্বলের দস্যুসর্দার করে তুলেছেন। দেখলে অাইনস্টাইন বোধ হয় বলতেন, ভারতীয়রা দিনভর ‘গো অ্যাজ় ইউ লাইক’ খেলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন