শিব ও উমার বিয়ের দিনটিই মহাশিবরাত্রি

পৌরাণিক মতে, হরগৌরীর বিবাহ হয় শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে। প্রতি কৃষ্ণপক্ষের চোদ্দোতম রাত্রিই শিবরাত্রি। ফাল্গুন মাসের এই রাত্রিটি হল মহাশিবরাত্রি। এটিকে বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত বলে মনে করা হয়। এই রাতেই মহাদেব গৌরীর পাণিগ্রহণ করেন। লিখছেন স্বপনকুমার ঠাকুরবিভিন্ন গুহাশিল্পে, মন্দিরগাত্রে কিংবা স্বতন্ত্র মূর্তিফলক হিসেবে এই মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০৩:২৪
Share:

বাবা ন্যাংটেশ্বর। মঙ্গলকোটের শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে। —ফাইল ছবি।

‘‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।

Advertisement

শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।।’’

ভারতীয় ভাবনায় শিব দেবাদিদেব। ব্রহ্মা-বিষ্ণুর সঙ্গেই উচ্চারিত তাঁর নাম। এক দিকে মহাপ্রলয়ের দেবতা, অপর দিকে তিনি কল্যাণসুন্দর। পণ্ডিতদের মতে শিব প্রাগার্য সংস্কৃতির দেবতা। মহেঞ্জোদরোর একটি সিলে পশুপতির প্রতিকৃতি খোদিত দেখা যায়। আবার বৈদিক রুদ্র ছিলেন বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়ঝঞ্ঝার দেবতা। পরে শিবের সঙ্গে এই রুদ্র সম্ভবত মিলেমিশে যান। শিবপত্নী উমা-পার্বতী। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। গুপ্ত-পাল-সেন পর্বে উমা-মহেশ্বরের যুগ্মমূর্তি জনপ্রিয় ছিল। বাংলার বিভিন্ন স্থানে এমন প্রস্তরমূর্তি অনেক পাওয়া গিয়েছে। বর্ধমান জেলার বিভিন্ন গ্রামে আজও হরগৌরীর প্রস্তরমূর্তি পূজিত হয়— যেমন কলিগ্রামে, মঙ্গলকোটের বনকাপাশি কিংবা কাটোয়ার বিকিহাট গ্রামে। আজও কুমারী মেয়েরা মনের মতো বরের কামনায় শিবপূজা করেন। শিব-পার্বতীর বিয়ের মূর্তিকে বৈবাহিক/ পাণিগ্রহণ/ কল্যাণসুন্দর মূর্তি বলা হয়। বিভিন্ন গুহাশিল্পে, মন্দিরগাত্রে কিংবা স্বতন্ত্র মূর্তিফলক হিসেবে এই মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।

Advertisement

শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে, মহাকাব্যে, প্রাচীন সাহিত্যে শিবের গার্হস্থ্য জীবন বর্ণিত হয়েছে। শিবের গলায় মালা দিয়েছিলেন দক্ষকন্যা সতী। শিব-বিরোধী দক্ষ এক বার শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে সতীর উপস্থিতিতে শিবের নিন্দা শুরু হল। সতী, পতির অপমানে যজ্ঞকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। শিব এসে দক্ষযজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নাচনে মেতে উঠলেন। সৃষ্টি বুঝি রসাতলে যায়। বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন বৃহত্তর ভারতবর্ষে। তার পরে মহাদেব গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন। এ দিকে, সতী জন্ম নিলেন হিমালয়কন্যা উমা রূপে। স্বর্গরাজ্য তখন অসুর, দানবদের করতলে। তারকাসুরকে বধ করতে চাই শক্তিশালী দেবসেনাপতি। ব্রহ্মা বললেন, যেমন করেই হোক উমার সঙ্গে মহেশ্বরের বিবাহ দিতে হবে। তবেই জন্ম হবে কার্তিকের। দেবতাদের প্রচেষ্টায় গৌরীর তপস্যায় মদন ভস্মের পরেই হরগৌরীর পরিণয় সুসম্পন্ন হয়।

পুরাণ-লোকশ্রুতি অনুসারে শিব-গৌরীর বিয়ের স্থানটি উত্তরাখণ্ডে রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ত্রিযুগীনারায়ণ গ্রামে। মন্দাকিনী ও শোনগঙ্গার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই পৌরাণিক জনপদটি ছিল হিমালয় রাজার রাজধানী। এই বিবাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। আর নারায়ণ গৌরীকে সমর্পণ করেন শিবের হাতে। চৈত্রে শিবগাজন উৎসব অনেকের মতে হর-কালীর বিয়ের অনুষ্ঠান। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন, ‘‘শিবের গাজনের প্রকৃত ব্যাপার হর-কালীর বিবাহ। সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী। তাহাদের গর্জন হেতু গাজন শব্দ আসিয়াছে। ধর্মের গাজনে মুক্তির সহিত ধর্মের বিবাহ হয়। দুই বিবাহ-ই প্রচ্ছন্ন।’’

তবে পৌরাণিক মতে, হরগৌরীর বিবাহ হয় শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে। অনেকেই বলেন, প্রতি কৃষ্ণপক্ষের চোদ্দোতম রাত্রিই শিবরাত্রি। কিন্তু ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চোদ্দোতম রাত্রি হল মহাশিবরাত্রি। এটিকে বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত বলে মনে করা হয়। এই রাতেই মহাদেব গৌরীর পাণিগ্রহণ করেন। এ দিন দেশের বহু শিবমন্দিরে হরগৌরীর বিবাহের অনুষ্ঠান হয়। বর্ধমান জেলায় শিবরাত্রিতে হরগৌরীর বিবাহ উৎসব না হলেও মেলা বসে এবং বিশেষ পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

শিবের মতোই প্রাচীন মেয়েলি আচার কৃত্য ব্রতানুষ্ঠান। মেয়েলি এই ব্রতের সঙ্গে বৈদিক বা পৌরাণিক ধর্মের কোনও যোগ নেই। পণ্ডিতেরা অনুমান করেছেন অনার্য মহিলাদের প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কৃতি ব্রতের মধ্যেই টিকে আছে। শিবরাত্রি এমনই এক প্রাচীন ব্রতানুষ্ঠান। এই ব্রত মহিলাদের হলেও নারীপুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ করতে পারেন। আগের দিন ভাল করে স্নান করে শুচি হয়ে নিরামিষ খেতে হবে। পর দিন সকালে স্নান আহ্নিক করে বেলপাতা, দুধ, ঘি, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ করার পালা। সারা দিন নিরম্বু উপবাসে থেকে রাতে চার প্রহরে চার বার যথাক্রমে দুধ, দই, ঘি, মধু দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করাতে হবে। এ দিন গান বাজনা করে রাত জাগার বিধি রয়েছে।

শিবরাত্রির মাহাত্ম্য বিষয়ক ব্রতকথাটি চমৎকার প্রাচীন লোকগল্পের দৃষ্টান্ত। প্রাচীন কালে বারাণসীতে এক ব্যাধ বাস করত। ব্যাধ এক দিন শিকার করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গাছতলায় বসে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙল তখন গভীর রাত। হিংস্র পশুর ভয়ে ব্যাধ সেই গাছে উঠে ডালে ঠেস দিয়ে শুয়ে পড়ে। গাছটি ছিল বেলগাছ, তার নীচে ছিল একটি শিবলিঙ্গ। ব্যাধ অতশত জানে না। রাতে তার নড়াচড়ার ফলে বেলপাতা আর শিশিরের জল পড়ে শিবলিঙ্গের মাথায়। সেটি ছিল মহাশিবরাত্রি। অভুক্ত ব্যাধ সকাল হতেই শিকার নিয়ে হাজির বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে তখন এক অতিথি। ব্যাধ নিজে না খেয়ে সেই অতিথিকে খাওয়াল। তার অজান্তেই শিবরাত্রি ব্রত সম্পূর্ণ হল। যথাসময়ে ব্যাধের মৃত্যু হলে যমদূতেরা হাজির, কিন্তু শিবরাত্রির ব্রত সম্পূর্ণ করার জন্য শিবদূতেরাও উপস্থিত। শিবের কৃপায় ব্যাধের স্থান হল শিবলোকে।

বর্ধমান জেলায়, বিশেষ করে কাটোয়া মহকুমার অনেক প্রাচীন গ্রামে শিবরাত্রির মেলা বসে। যেমন মঙ্গলকোট থানার চৈতন্যপুর গ্রামে রয়েছে অনাদি শিবলিঙ্গ শৈলেশ্বর। কাটোয়ায় সন্ন্যাস নিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দিব্যোন্মাদে তিন দিন রাঢ় ভ্রমণ করেছিলেন। ফিরে আসার সময়ে এই জনপদে তাঁর পূর্বেকার স্মৃতি ফিরে পান। এই সূত্রে স্থানটির নাম হয় চৈতন্যপুর। এই গ্রাম থেকেই মিলেছে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের বিষ্ণুর ব্যতিক্রমী আভিচারিক মূর্তি, বর্তমানে সেটি ভারতীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত। চৈতন্যপুরের শৈলেশ্বরের পুজোয় মেলা বসে। গ্রাম-গ্রামান্তরের কুমারী মেয়েরা-সহ অনেকেই পুজো দিতে আসেন। কাটোয়ার ঘোষেশ্বরতলাতেও শিবরাত্রিতে অসংখ্য পুণ্যার্থী আসেন। পুইনি গীতগ্রাম সিঙ্গি প্রভৃতি গ্রামে শিবরাত্রিতে জাঁকজমক-সহ পূজা হয়। কেতুগ্রামের বিল্বেশ্বরে বাবা বিল্বনাথকে কেন্দ্র করে শিবরাত্রিতে মেলা বসে। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বসে লোকসংস্কৃতির বর্ণময় আসর।

মঙ্গলকোটের শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে শিবরাত্রিতে বিশেষ ভাবে পূজিত হন বাবা ন্যাংটেশ্বর। ইনি আদতে জৈন তীর্থঙ্কর শান্তিনাথ। এক সময় মঙ্গলকোট-সহ সমগ্র রাঢ় অঞ্চলে জৈনধর্মের প্রাধান্য ছিল। মঙ্গলকোটের রাইতো দিঘি থেকে আবিষ্কৃত, বর্তমানে শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে পূজিত শান্তিনাথের বিগ্রহটি কালো কষ্টিপাথরে খোদিত। উচ্চতায় চার ফুট। চালিতে বিদ্যাধরের নীচে মূল মূর্তির পাশে আরও দু’জন তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে। পাদপীঠে সুসজ্জিত চামরধারীর পাশে আরও দু’টি তীর্থঙ্করের মূর্তি। মৃগ লাঞ্ছন দেখে বোঝা যায় এটি শান্তিনাথের বিগ্রহ। আনুমানিক দশম শতকের এই বিরল মূর্তিটি পঞ্চতীর্থক জৈনমূর্তির দৃষ্টান্ত। এই মূর্তিটিই শিবের ধ্যানে পূজিত হয় ন্যাংটেশ্বর নামে। বাৎসরিক উৎসব শিবরাত্রির সময়। মেলা বসে, নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। ন্যাংটেশ্বরের মিলন মেলায় মেতে ওঠেন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার মানুষ।

লেখক গবেষক ও ক্ষেত্রসমীক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন